নয়াদিল্লি: শারীরিক অসুস্থতার জেরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রায় শামিল হতে পারেননি। সারাজীবন সেই আক্ষেপ থেকে যাবে বলে লিখেছিলেন। কিন্তু একমাস পর তিনি নিজেই যা আর থাকবেন না, তা আঁচ করতে পারেননি বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি। গত ৮ অগাস্ট মারা যান বুদ্ধদেব। এক মাস, চার দিন পর, ১২ সেপ্টেম্বর 'বুদ্ধদা'কেই অনুসরণ করলেন, অনুজপ্রতিম সীতারাম। বুদ্ধদেবের মৃত্যুতে একসঙ্গে কাটানো বিভিন্ন মুহূর্ত, কঠিন সময়ের স্মৃতিচারণে ডুব দিয়েছিলেন তিনি। আজ সীতারামের প্রয়াণেও আলোচনায় উঠে আসছে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন মুহূর্ত। (Sitaram Yechury Demise)
১৯৫২ সালের ১২ অগাস্ট তদানীন্তন মাদ্রাজে তেলুগু পরিবারে জন্ম সীতারামের। বাবা ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশ পরিবহণ দফতরের ইঞ্জিনিয়ার, মনা সরকারি আধিকারিক। হায়দরাবাদেই বেড়ে ওঠেন সীতারাম। ১৯৬৯ সালে তেলঙ্গানা আন্দোলন শুরু হলে দিল্লি চলে আসেন। CBSE-র উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় দেশের মধ্যে প্রথম হন তিনি। অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা। JNU-তেই অর্থনীতিতে Ph.D শুরু করেন। কিন্তু জরুরি অবস্থা চলাকালীন গ্রেফতার হলে, গবেষণা থমকে যায়। (Sitaram Yechury Dies)
জরুরি অবস্থার পর JNU-এর একটি অনুষ্ঠানে ইন্দিরা গাঁধীর প্রবেশ আটকান সীতারাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদ থেকে ইন্দিরার পদত্যাগ দাবি করে ইন্দিরার বাসভবনে যান তিনি ও অন্য ছাত্ররা। সেখানে ইন্দিরার সামনেই তাঁর পদত্যাগের দাবিপত্র পড়ে শোনান সীতারাম। রাগ, অসন্তোষ নয়, হাসিমুখেই সীতারামের বক্তব্য শোনেন ইন্দিরা, যে ছবি আজও সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসে ঘুরেফিরে।
তবে সনিয়া গাঁধী এবং রাহুল গাঁধীর সঙ্গে সুসম্পর্কে সেই ঘটনা কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ২০০৪ সালে কেন্দ্রে UPA সরকার গঠিত হওয়ার আগে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের সঙ্গে দেখা করেন সনিয়া। সেখান থেকে ফিরেই সীতারামকে ফোন করেন সনিয়া। জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে সীতারাম জানান, ১৯৯৬ সালে তাঁদের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দেওয়া হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জ্যোতি বসু, হরকৃষ্ণ এবং তিনি। ২০০৮ সালেও আবারও প্রধানমন্ত্রিত্বেক প্রস্তাব দেওয়া হয়। লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিংহ যাদব, দেবগৌড়া, চন্দ্রশেখর, করুণানিধি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। রাজ্যের সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের সরকারের নীতির মিল না হলে, পরিস্থিতি বেগতিক হতে পারে ভেবেই গ্রহণ করা হয়নি প্রস্তাব।
১৯৭৪ সালে সিপিএম-এর ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (SFI)-য় যোগদান সীতারামের। এক বছর পর সিপিএম-এর সদস্যতা গ্রহণ। ১৯৭৫ সালে যখন গ্রেফতার হওয়ার পর ছাড়া পেলেও, বেশ কিছু দিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন। সেই অবস্থাতেই জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। জরুরি অবস্থার অবসান ঘটলে JNU-এর ছাত্র সংসদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। JNU-এ আজও বামেদের যে দুর্গ টিকে রয়েছে, তার মূল কারিগর সীতারাম এবং প্রকাশ কারাট।
১৯৭৮ সালে SFI-এর সর্বভারতীয় সম্পাদক নির্বাচিত হন সীতারাম। সেই প্রথম কেরল এবং বাংলার বাইরে অন্য কেউ SFI-র নেতৃত্বে বসেন। ১৯৮৪ সালে জায়গা পান সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে। ১৯৮৫ সালে দলের সংবিধান সংশোধন করে পাঁচ সদস্যের যে কেন্দ্রীয় সেক্রেট্যারিয়ট গঠিত হয়, তাতে সুনীল মৈত্র, পি রামচন্দ্রণ, এস রামচন্দ্রণ পিল্লাইয়ের পাশাপাশি সীতারাম এবং প্রকাশও ঠাঁই পান। ১৯৮৬ সালে SFI ছাড়েন সীতারাম। ১৯৯২ সালে দলের চতুর্দশ কংগ্রেসে জায়গা পান পলিটব্যুরোয়। ২০১৫ সালে দলের ২৩তম কংগ্রেসে সিপিএম-এর পঞ্চম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৮ এবং ২০২২ সালে পুনর্নির্বাচন হলে ফের ওই পদে আসীন হন তিনি।
হরকৃষ্ণ সিংহ সুরজিতের পর কেন্দ্রে জোট সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব সামলাতেন সীতারামই। ১৯৯৬ সালে পি চিচম্বরমের সঙ্গে মিলে অভিন্ন ন্যূনতম প্রকল্পের খসড়ার প্রস্তুতেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে কেন্দ্রে যে UPA সরকার গঠিত হয়, তার অন্যতম রূপকার ছিলেন সীতারাম। কেন্দ্রে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে বরাবর সওয়াল করে গিয়েছেন। ঐক্যবদ্ধ, বহুত্ববাদী ভারতের পক্ষে ছিলেন তিনি।
২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হন সীতারাম। ইন্দো-আমেরিকা পরমাণু চুক্তি নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, সেই সময় সরকারের তরফে কী কী শর্ত তুলে ধরা প্রয়োজন, সংসদে তার তালিকা তুলে ধরেন। মনমোহন সিংহ সরকারের তরফে সেই শর্তপূরণ হলেও, প্রকাশ আপত্তি তোলেন। ওই চুক্তি সিপিএম-এর স্বাধীন বিদেশ নীতির পরিপন্থী বলে জানান প্রকাশ, যা নিয়ে দু'জনের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ২০১৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অভিভাষণে সংশোধনের প্রস্তাব আনেন সীতারাম।
বরাবর আমেরিকার বিদেশনীতির সমালোচক ছিলেন সীতারাম। ২০১৫ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান অতিথি হিসেবে বারাক ওবামাকে আমন্ত্রণে আপত্তি জানান তিনি। পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার আগ্রাসী আচরণেলর জেরেই মৌলবাদের এত বাড়-বাড়ন্ত বলে মন্তব্য করেন তিনি। ISIS-এর মতো জঙ্গি সংগঠনকে আমেরিকাই জন্ম দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন। সব দেশে আমেরিকার নাগ গলানোয় আপত্তি তোলেন। জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য সংরক্ষিত অনুচ্ছেদ ৩৭০-এরও বিরোধিতা করেন তিনি।
ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়েছিলেন সীতারাম। তাঁদের এক কন্যা, অখিলা ইয়েচুরি, যিনি ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরার অধ্যাপিকা। দ্বিতীয় বার সাংবাদিক সীমা চিস্তির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সীতারাম। একটি সাক্ষাৎকারে সীতারাম জানান, স্ত্রীর আয়ের উপরই নির্ভরশীল তিনি। ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৩৪ বছর বয়সে মারা যান তাঁর ছেলে আশিস ইয়েচুরি। গত ১৯ অগাস্ট দিল্লির AIIMS-এ ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হন সীতারাম। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সাহায্যে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস চালু ছিল। বৃহস্পতিবার সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ইয়েচুরি। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নিউমোনিয়াকে।