ডোনাল্ড জে ট্রাম্পকে ইমপিচ করল মার্কিন জনপ্রতিনিধি সভা। ৪৫-তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, তিন বছর যে গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন এবং অনেকেই বলছেন, ২০২০-র নভেম্বরের নির্বাচনের পর আরও চার বছর হয়তো থেকেই যাবেন, কখনই তাতে থাকার যোগ্য মানুষ ছিলেন না। মার্কিন ভাষ্যকারদের অনেকে এই সেদিনও তাঁকে ‘অ-প্রেসিডেন্টসুলভ’ বলেছেন, তুলনামূলক কম কট্টর লোকজন তাঁকে ‘বিকৃতমস্তিষ্ক’ বলেছেন। এঁরা হলেন সেই মানুষজন যাঁরা তাঁর রেখেঢেকে সমালোচনা করেন। তিনি বুক বাজিয়ে মেক্সিকানদের ‘ধর্ষক’, মহিলাদের ‘শুয়োর’, ‘কুকুর’ বলেছেন, প্রকাশ্যে বলেছেন যে, তিনি নিউ ইয়র্কের ফিফথ এভিনিউয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যে কাউকে গুলি করতে পারেন, এতে তাঁর কিছুই হবে না, তিনি একটি ভোটারও হারাবেন না।


জনপ্রতিনিধি সভা তার কাজ করেছে। হাউস জুডিশিয়ারির চেয়ারম্যান জেরোম নাডলার বলেছেন, গণতন্ত্রের একজন স্বৈরতন্ত্রীর হস্তগত হওয়া রুখতে ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট দরকার ছিল। ডেমোক্র্যাটরা একসুরে সওয়াল করেছেন যে, প্রেসিডেন্ট তাঁর ব্যক্তিগত লাভের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা বিসর্জন দিতে পারেন না এবং সামনের বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য একটি বিদেশি রাষ্ট্রের সরকারের সহায়তা নিয়ে তিনি নিজের পদ, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় একটি অভিযোগও রয়েছে যে, নথিপত্র আটকে রেখে, স্পষ্ট মিথ্যাচার করে, নিজের দপ্তর বা ক্যাবিনেটের কর্মীদের কাউকে সাক্ষ্য দিতে নিষেধ করে, কংগ্রেসের সপিনার জবাব না দিয়ে কংগ্রেসের সামনে অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন। এগুলি সবই সত্যি।
অনেক মার্কিনই, এমনকী যাঁরা ঘনিষ্ঠ মহলে হয়তো ট্রাম্পের প্রতি পুরোপুরি নির্দয় হবেন না, এবার বলবেন ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট মার্কিন গণতন্ত্রের জয়। কিন্তু গোটা দুনিয়াকে স্মরণ করাতে চাই, আমেরিকার মানুষের ইচ্ছার জয় হলেও, প্রত্যেকে এও জানেন যে, ট্রাম্পকে রেহাই দেবে রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন সেনেট। ডেমোক্র্যাটদের কথাও বলব। কী রিপাবলিকান, কী ডেমোক্র্যাট, প্রেসিডেন্ট যিনিই থাকুন, তাঁর আমলে আমেরিকা যেভাবে কয়েক ডজন বিদেশি রাষ্ট্রের নির্বাচনে নাক গলিয়েছে, দুনিয়াব্যাপী গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত নেতাদের অপসারণে মদত দিয়েছে, সেটা মনে রাখলে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের এত প্রতিবাদের কী আছে?

ট্রাম্পের নিন্দুক, ভক্তরা একসুরে তাঁর ইমপিচমেন্টকে ‘ঐতিহাসিক’ বলছেন। ট্রাম্প তো বলা শুরু করে দিয়েছেন যে, এটা শুধু ‘ঐতিহাসিক’ই নয়, আমেরিকার ইতিহাসে ‘অভূতপূর্ব’ও বটে, এ দেশে এর আগে এত বড় ডাইনি খোঁজা অভিযান হয়নি। ট্রাম্প এমনকী এও সওয়াল করেছেন যে, ১৬৯২-৯৩ এ ম্যাসাচুসেটসের সালেমে ডাইনি গণ্য করে বিচার যেসব দুর্ভাগা মহিলা, কিছু পুরুষের বিচার করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের ক্ষেত্রেও তাঁর থেকে বেশি বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এটা একেবারে বাজে কথা। ইমপিচমেন্ট ট্রাম্পের কাছে একটা প্রাপ্তি, এটা উতরে গেলে তাকে আরও বড় একটা সাফল্য বলে দেখাবেন তিনি। এগুলি সম্ভব হচ্ছে কেননা ট্রাম্প হলেন নীতিনিষ্ঠ প্রতিটি মানুষের কাছে এক গভীর সমস্যার জীবন্ত উদাহরণ। লজ্জাবোধ নেই, এমন একজনকে কী করে অন্যদের সামনে তুলে ধরা যায়? যিনি ভাবেন যে তাঁকে লজ্জায় ফেলা যাবে না, কী ভাবে তাঁকে বোঝানো যায়? তাঁর তুলনা হতে পারে সেই পদ্মের সঙ্গে জল পড়ার পরও যা সেই শুষ্কই থাকে। প্রতিটি সংস্কৃতিতে যুগে যুগে পদ্মকে পবিত্রতার প্রতীক ধরা হয়। ট্রাম্প যত দূর কল্পনা করা যেতে পারে, পবিত্রতার সঙ্গে সংশ্রবহীন। কিন্তু কিছুই বোধহয় তাঁকে স্পর্শ করে না।

পরিষ্কার কথাটা বলি। ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট ঐতিহাসিক কিছুই নেই। এটা শুধু এ কারণে নয় যে, অ্যান্ড্রু জনসন, বিল ক্লিনটনকেও ইমপিচ করা হয়েছিল। (নিক্সন ওয়াটারগেট টেপ প্রকাশ হওয়ার পর ইমপিচমেন্টের আগেই ইস্তফা দেন, নিজের সমর্থকদের কাছেও স্পষ্ট করে দেন, তিনি সোজা মিথ্যা বলেছিলেন।) কিন্তু বর্তমান ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, একজন রিপাবলিকানও ইমপিচমেন্টের ধারার পক্ষে ভোট দেননি। ভাষ্যকাররা একে ‘পার্টিজান ডিভাইড’ বলছেন এবং প্রায় সকলেই একমত, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই বিভাজন তীব্রতর হয়েছে। ঠিক কখন এই বিভাজন বাড়তে শুরু করল এবং বর্তমান রাজনৈতিক আবহাওয়ার উত্থানে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের ভূমিকা কতখানি, সেই প্রশ্ন অবান্তর। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা ওবামার উঠে আসা সহ্য করতে পারেনি, ভেবেছে, তাদের চেনা আমেরিকা তাদের চোখের সামনে হারিয়ে যেতে বসেছে এবং তাকে ‘পুনরুদ্ধার’ করতে হবে।

কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এই বিভাজন ‘ন্যয়সঙ্গত রাজনীতি’। কিন্তু এর গুরুত্ব কি আরও বেশি কিছু হতে পারে? আমরা কি এই ভাষ্য মেনে নেব যে, আমেরিকা লাল আর নীল প্রদেশে আলাদা হয়েছে? মূলত উপকূল এলাকা আর বিশাল পশ্চাদ্ভূমির মধ্যে? বিশাল বেতনের চাকরি করা শহুরে শিক্ষিত আর কম মাইনার ব্লু-কলার অর্থাত কায়িক পরিশ্রমের চাকরি করা লোকজনের মধ্যে? গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলির দায়িত্ব যেভাবে বন্টন হয়, সেটা মাথায় রাখলে এটা পুরোপুরি কাকতালীয় মনে হতে পারে। ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তিন শীর্ষ ডেমোক্র্যাট- হাউসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, ইনটেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম স্কিফ ও নাডলার, সবাই নিউ ইয়র্ক বা ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিনিধি। দুটি প্রদেশকেই ট্রাম্প ও রিপাবলিকানরা (ট্রাম্প নিজে অবশ্য নিউ ইয়র্কেরই) অতি-বাম, আমেরিকার বাকি অংশের সঙ্গে ‘সম্পর্কহীন’, এলিটবাদী বলে সমালোচনা করে থাকেন। সত্যিই একটা ‘বাম’ পার্টি কেমন হয়, তার কোনও ধারণাই ওদের নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ব্যাপক স্বীকৃতি পাওয়া ভাষ্যের আড়ালে কি বিপন্ন হতে বসা আরও বড় কিছু রয়েছে?

এই পার্টিজান বিভাজনের পিছনে যে চরম সত্যটা রয়েছে এবং মার্কিন গণতন্ত্র সম্পর্কে যে বোকা বোকা দাবি করা হয়, তা নিয়ে, প্রায় কেউই কিছু বলতে চান না। রিপাবলিকান পার্টি স্রেফ কিছু উগ্র ধর্মান্ধ, জাতিবিদ্বেষী, ‘সাদা চামড়ার সম্পত্তির মালিক’কে নিয়েই গড়ে ওঠেনি। ওটা আক্ষরিক অর্থেই অনুতাপহীন, অধঃপতিত, ঘৃণায় ভরা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের পার্টি। জাতিবিদ্বেষ একেবারে ওদের মর্মে। এর মানে এই নয় যে, ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে কোনও জাতিবিদ্বেষী নেই। কেউ কিছু ব্যাপারে ‘প্রগতিশীল’, অন্য সব ক্ষেত্রে পুরোপুরি পশ্চাত্পন্থী হতে পারে। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টিকে আলাদা করে চেনা যায় এজন্য যে, তাদের গোটা নেতৃত্বই জাতিবিদ্বেষে বিশ্বাসী করে। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাঁদের অকুন্ঠ সমর্থনেই এটা দেখা গিয়েছে। আর নেতাদের সম্পর্কে যেটা সত্যি, সেটা তাঁর অগণিত ভক্তদের ক্ষেত্রেও সত্যি, যাঁরা তাঁর সভায় ভিড় করেন, যাঁদের টিভি স্ক্রিনে ফ্যুয়েরারের পিছনে হাসি মুখে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টে কি কিছু বদলাবে? নিশ্চিত হতে গেলে রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ করতে পারেন কেউ, এখন থেকে এক বছর বাদে যে নির্বাচন হবে, তাতে এই ঘটনা থেকে কোন দলের বেশি লাভ হবে, তা নিয়ে অন্তহীন আলেচনা-তর্ক হতে পারে। কিন্তু তাতে একটা গভীর সঙ্কটকে লঘু করে ফেলা হবে, যা আমাদের অবশ্যই রোধ করা উচিত। নারীবাদীরা বলতে পারেন, আমেরিকার জনতার সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা যৌন অপরাধ, নারীবিদ্বেষ, যেমন মার্কসবাদীরা হয়তো বলবেন, অতি-ধনী ও গরিবদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান, বিরাট অর্থনৈতিক ব্যবধানই আমেরিকানদের (এবং গোটা পৃথিবী) কাছে সবচেয়ে বিপদ। তাঁরা যে যাঁর মতো ভাবতেই পারেন, কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির স্বাতন্ত্র্য রয়েছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী দর্শনের প্রতি ওদের গভীর আস্থায়। ওরা দাস মালিকদের চিন্তা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। দাস মালিকরাই দক্ষিণের প্রদেশগুলিকে জোর করে বিচ্ছিন্ন করেছিল, যা গৃহযুদ্ধে মোড় নেয়।
ফলে সেই অর্থে ইমপিচমেন্টের কোনও গুরুত্বই নেই, থাকবেও না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমেরিকার কাহিনির একেবারে মূলে থাকা অত্যন্ত ক্ষতিকর শ্বেতাঙ্গ জাতিবিদ্বেষকে তার মাটি থেকে মূল ও শাখাপ্রশাখা সমেত একেবারে উপড়ে ফেলা হচ্ছে।