সব্যসাচী আর মামনি রায় পেশায় স্বাস্থ্যকর্মী। বাড়ি পুরুলিয়ার কুস্তাউর স্টেশন থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে, বাতিকরা গ্রামে। দুজনেই শ্রীরামপুরের শ্রমজীবী হাসপাতালে কর্মরত। সরকারি উদ্যোগে যা এখন করোনা হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়েছে। আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সব্যসাচী-মামনি অতিমারী মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
এবিপি আনন্দকে সব্যসাচী বললেন, ‘সেই মার্চের শুরুতে বাড়ি থেকে এসেছি। আমাদের ছেলে সায়নের বয়স মাত্র ৯ বছর। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠবে। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। ৫ মাস বাড়ির বাইরে আছি। ছেলেকে আর রাখা যাচ্ছে না। ফোনে কান্নাকাটি করে। ভিডিও কলে কথা বলি। সান্ত্বনা দিই। বোঝাই।’
মামনি হাসপাতালে নার্সের কাজ করেন। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ভীষণ মন খারাপ ছেলের জন্য। ও বায়না করে। ওকে বোঝাচ্ছি, বাস-ট্রেন চলছে না। তাই ফিরতে পারছি না। ছেলে বলে, আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। তোমরা এসো। ওকে বুঝিয়ে চলেছি যে, গাড়ি পাঠালে পুলিশ ধরবে। আমরা ফিরলেও বাড়ির লোক, পাড়ার বাসিন্দারা ঢুকতে দেবে না। ও দেখছে আশপাশে। বুঝতে পারছে কিছুটা। বন্ধুরা বলছে, তোর মা-বাবা এখন আসতে পারবে না। ও মুষড়ে পড়ছে।’
করোনা হাসপাতালে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছে রায় দম্পতি। সব্যসাচী-মামনি রোগীদের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছেন যে, এক করোনা আক্রান্তের আবদারে হাসপাতালের সকলকে ইলিশ মাছ খাইয়ে দিয়েছেন! সব্যসাচী বললেন, ‘এক করোনা আক্রান্ত জানিয়েছিলেন, ইলিশ খেতে তিনি ভালবাসেন। শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। বলেছিলাম, চেষ্টা করছি খাওয়ানোর। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে প্রায় ৫ হাজার টাকা দিয়ে ইলিশ কিনে আনলাম।’
স্থানীয় ব্যবসায়ীর উদ্যোগে মিষ্টিমুখ (বাঁদিকে), সকলের পাতে পড়ল ইলিশ
স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই রোজগার সামান্য। তার পরেও রোগীর আবদার মেটাতে এত তৎপরতা? সব্যসাচী বললেন, ‘করোনা রোগীরা মানসিকভাবে কুঁকড়ে থাকছেন। ইলিশ মাছটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে তো যে কেউই খাওয়াতে পারত। কিন্তু আন্তরিকতাটাই আসল। ওঁদের বোঝাতে চেয়েছি যে, এই লড়াইয়ে ওঁরা একা নন।’ সব্যসাচীদের উদ্যোগ দেখে হাসপাতাল পার্শ্ববর্তী মিষ্টির দোকানের মালিক উজ্জ্বল ঘোষ রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মিষ্টিমুখ করিয়েছেন।
করোনা রোগীদের ডায়েটে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন। মাছ-মাংস রোজই খাওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। শ্রমজীবী হাসপাতালে মাছ-ডিম নিয়মিত দেওয়া হয়। সব্যসাচীদের ইলিশ খাওয়ানোর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন হাসপাতালের সুপার, চিকিৎসক সুমিত তালুকদার। বললেন, ‘চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে আক্রান্তদের এই মানসিক বন্ধন চিকিৎসার ক্ষেত্রেও সাহায্য করে। রোগীরা মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকেন। সুস্থ হয়ে ওঠার পর বেশিরভাগ রোগী বাড়ি ফিরতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদেরও একই অভিজ্ঞতা হচ্ছে। পরিস্থিতির জন্যই একাত্ম বোধ করছেন সকলে।’ যোগ করলেন, ‘স্বল্প রোজগার শ্রমজীবীর স্বাস্থ্যকর্মীদের। সেখানে দাঁড়িয়ে মহৎ উদ্যোগ সব্যসাচীদের। তবে অনেককেই আমরা পাশে পাচ্ছি। একটি বিখ্যাত জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থা নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য জুতো দিয়েছে। এক ব্যক্তি সকলের জন্য চা-কফি পাঠিয়েছেন।’
সারাদিন পিপিই কিট পরে ৬ ঘণ্টা ডিউটি যে তাঁদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলেছে, জানালেন সব্যসাচী। বললেন, ‘পিপিই কিট পরে ৬ ঘণ্টা ডিউটি করা ভীষণ কঠিন। ঘর্মাক্ত হয়ে যাই। ক্লান্ত হয়ে পড়ি।’
অনেক প্রতিকূলতা সামলাতে হচ্ছে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের। শ্রমজীবীর সুপার বললেন, ‘ডিউটি সেরে ফেরার পর বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না অনেককে। শুধু পাড়ার লোক নয়, আত্মীয়রাও বাড়ি ফিরতে বাধা দিচ্ছেন। শ্রমজীবী হাসপাতালের খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে গিয়ে সমস্যা হয়েছে। করোনা হাসপাতালের প্রতিনিধি শুনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখেছি, হাসপাতালের সামনে অটো বা গাড়ির গতিও বেড়ে যায়। যেন ভাইরাস উড়ে এসে গায়ে পড়বে! স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। সচেতনতা বাড়াতে আরও প্রচার দরকার।’
শ্রীরামপুর শ্রমজীবী থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪৩০ জন করোনা আক্রান্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ১০০ বেড রয়েছে করোনা রোগীদের জন্য। ৯০ জন আক্রান্ত এখন চিকিৎসাধীন। চিকিৎসক তথা সুপার সুমিত তালুকদার বলছেন, ‘ভীষণ কঠিন এই লড়াই। সাফাইকর্মী থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সকলেই শুরুর দিকে ভয় পেয়েছেন। আমাদের হাসপাতালে আইসিইউয়ের মধ্যে নার্সিং স্টেশন। অনেকে ঢুকতে ভয় পায়। নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহসিকতাকে কুর্নিশ।’
হাসপাতালে কর্মরত আর এক নার্স পুতুল হেমব্রমের বাড়ি পাণ্ডুয়ায়। বাড়িতে চার বছরের শিশুপুত্র। তাকে ফেলেই কর্তব্যপালন করে চলেছেন পুতুল। আর এক নার্স মৌসুমী দাস। বাবা-মেয়ের সংসার। মেয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না। সমস্যায় পড়েছেন মৌসুমীর বাবা। এত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কাজ করার উদ্যম পান কীভাবে? মামনি বলছেন, ‘শুরুর দিকে ভীষণ ভয় করছিল। এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। করোনা রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে কী যে আনন্দ হয়!’
আর সব্যসাচী বলছেন, ‘প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে প্রত্যেক মুহূর্তে। মাঝে-মধ্যে ভাবি, কোনওভাবে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে! বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কী হবে! ভীষণ আশঙ্কায় দিন কাটাই।’