কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা: তাঁর ফ্ল্যাটে ম্যারাথন তল্লাশি চালিয়েছে সিআইডি। পাল্টা অডিও বার্তায় সুর চড়িয়েছেন ভারতী ঘোষ। কিন্তু, প্রাক্তন আইপিএস অফিসার এখন কোথায় আছেন, তার হদিস নেই সিআইডি-র। এদিকে, সোনা লুঠের মামলায় এদিনআরও এক ভারতী ঘনিষ্ঠ পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতার করল সিআইডি। আটক করা হয়েছে ভারতীর গাড়ির চালক দলবীর সিংহকেও।
পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রাক্তন পুলিশ সুপার এবং তাঁর দেহরক্ষী, প্রাক্তন কনস্টেবল সুজিত মণ্ডলের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছেন রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের দুঁদে অফিসাররা। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি গুজরাত সহ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে সিআইডির ছোট ছোট দল।
গোয়েন্দা সূত্রে দাবি, ভারতী এবং সুজিত দুজনেই রাজ্যের বাইরে আছেন। ভারতী ঘোষ নিজেও অডিওবার্তায় সেকথা জানিয়েছেন। বলেছেন, আমি বাইরে আছি। ফিরে ব্যবস্থা নেব।
গত কয়েকদিনে হোয়াটসঅ্যাপ মারফত এরকম প্রায় পাঁচটি অডিওবার্তা দিয়েছেন ভারতী ঘোষ। এই প্রেক্ষিতে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, মোবাইলের সূত্র ধরেও ভারতীর হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? গোয়েন্দা সূত্রে দাবি, পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার থাকাকালীন জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের উপর নজরদারি চালাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতেন ভারতী ঘোষ।
সিআইডি-তেও তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সিআইডি কীভাবে তাঁর খোঁজ করতে পারে এবং গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে কী কী করতে হবে, তা পুরোটাই তাঁর জানা। তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে এই বিষয়গুলি জানেন সুজিতও। সেই কারণেই তাঁরা গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে এতদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারছেন।
সিআইডি-র তল্লাশি অভিযান শুরু হয় দাসপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী চন্দন মাজি দায়ের করা একটি অভিযোগের সূত্র ধরে। এই অভিযোগটি দায়ের করেন ১ ফেব্রুয়ারি। সিআইডি-র অনুমান, মামলা হওয়ার কথা আঁচ করে সম্ভবত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহেই রাজ্য ছাড়েন ভারতী ঘোষ ও সুজিত মণ্ডল।
শেষবার তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা যায় ২৪ জানুয়ারি, মেদিনীপুরের একটি অনুষ্ঠানে। ভারতী ঘোষের স্বামী এমএভি রাজুর সঙ্গেও সিআইডি-র কার্যত লুকোচুরি চলছে। সিআইডি প্রথমবার ৬ ফেব্রুয়ারি নোটিশ দিয়ে রাজুকে ডেকে পাঠায়। পরদিন ভবানী ভবনে গিয়ে রাজুর আইনজীবী জানান, তিনি অসুস্থ। ফের তাঁকে ১০ তারিখ দেখা করতে বলে নোটিস জারি করা হয়। সেই দিনও রাজু ভবানী ভবনে যাননি। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার রাজুর আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, ১৫ মার্চ পর্যন্ত তাঁকে গ্রেফতার করা যাবে না।
মাজির দায়ের করা সোনা লুঠের মামলায় ইতিমধ্যে ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার, ভারতী ঘোষ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত একাধিক পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এদিনই গ্রেফতার করা হয় এএসআই দেবাশিস দাসকে। ঝাড়গ্রামের মোটর ট্রান্সপোর্ট অফিসার ছিলেন দেবাশিস। সিআইডি সূত্রে দাবি, নোট বাতিলের সময় সোনা পাচারে ব্যবহৃত গাড়ি। ধৃতের নখদর্পনে সমস্ত গাড়ির গতিবিধি। ভবানী ভবনে ডেকে দিনভর জেরার পরে গ্রেফতার করা হয় দেবাশিস দাসকে।
পাশাপাশি, গোয়েন্দাদের নজরে পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রাক্তন পুলিশ সুপারের দুই গাড়ি চালকও। ইতিমধ্যেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী-ভরতগড় এলাকা থেকে ভারতীর গাড়ির চালক দলবীর সিংহকে আটক করেছে সিআইডি। পুলিশ সূত্রে খবর, সপ্তাহখানেক আগে বাসন্তী থানা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলেন দলবীর। বৃহস্পতিবার তাঁকে আটক করে সিআইডির হাতে তুলে দেয় বাসন্তী থানার পুলিশ।
সিআইডির অনুমান, এই দুই গাড়ি চালকের মাধ্যমে টাকা ও সোনা পাচার হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু, কোথায় পাচার হয়েছে টাকা বা সোনা? এই প্রশ্নেরই উত্তর প্রাক্তন আইপিএসের দুই গাড়ি চালকের কাছে থাকতে পারে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। সিআইডি-র অনুমান, দুই গাড়ি চালকের কাছ থেকে ভারতীর গতিবিধি সংক্রান্ত তথ্যও মিলতে পারে।
আপাতত দলবীর সিংহকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন তদন্তকারীরা। অপর চালকের খোঁজ চালাচ্ছে সিআইডি। এরই মধ্যে শুক্রবার ভারতী ঘোষ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, ঘাটালের তৎকালীন সিআই শুভঙ্কর দে, ঘাটাল থানার তৎকালীন ওসি চিত্ত পাল এবং ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার রাজমঙ্গল সিংহকে আদালতে পেশ করে সিআইডি। ২ পুলিশকর্মীর ৫ দিনের পুলিশ হেফাজত এবং রাজমঙ্গলকে ১০ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠান বিচারক।
এদিকে ৬ ফেব্রুয়ারি, মাদুরদহের একটি বন্ধ ফ্ল্যাট থেকে আড়াই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি করেছিল সিআইডি। পরে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ফ্ল্যাটটি অভিজিৎ চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তিকে আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন ভারতী। এরপর তাঁর ফ্ল্যাটে ভয় দেখিয়ে, জোর করে টাকা রাখার অভিযোগে, আনন্দপুর থানায় ভারতীর স্বামীর বিরুদ্ধে এফআইআর করেন ওই ফ্ল্যাট মালিক। সেই মামলায় শুক্রবার আলিপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান এম এ ভি রাজু।