কমলকৃষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান : রাজ আমলে প্রতিষ্ঠিত। কয়েকশো বছর পর বর্ধমানের শূলিপুকুরের নাম পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন নাম হচ্ছে জীবন সায়র। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। জানা যাচ্ছে, রাজ আমলে যারা দস্যুবৃত্তির সাথে যুক্ত ছিল বা যারা অপরাধমূলক কাজ করত, তাদের বর্ধমান রাজ কর্তৃক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দানের জন্যই রাজবাড়ির অদূরে তৈরী করা হয় শূল এবং তাকে কেন্দ্র করে তৈরী করা হয় পুষ্করিণী। যা পরবর্তীতে বর্ধমানবাসীর কাছে শূলিপুকুর নামে পরিচিত।


শূলিপুকুরের নাম পরিবর্তন নিয়েই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা রাহুল সিনহার অভিযোগ, 'শূলিপুকুরের সাথে বর্ধমানের রাজাদের ইতিহাস এবং বর্ধমানের সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে। তৃণমূলের কাজ হচ্ছে ভারতীয় ইতিহাস ও স্থানীয় ঐতিহ্যকে মুছে ফেলা। নতুন করে সৃষ্টি করারও ক্ষমতা নেই শুধু ইতিহাসকে ধ্বংস করতে পারে। নাম পরিবর্তন করা মানে তো মানুষকে ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়া। পরিকল্পিতভাবেই এটা করছে তৃণমূল। আমরা বিদেশী সংস্কৃতি, কলঙ্ককে মুছে ভারতীয়ত্ব করেছি।' পাল্টা জবাবে জেলা তৃণমুলের মুখপাত্র প্রসেনজিত দাসের দাবী, 'আমরা রাজার ইতিহাসকে আরও যত্নকরে রাখার জন্য পুকুরটিকে সাজিয়ে তুলেছি। বিভিন্ন স্টেশন ও জায়গার নাম পরিবর্তন করেছে বিজেপি। ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পুকুরটিকে সাজিয়ে রাজার নামের মত করে জীবন সায়র নাম রাখা হচ্ছে। বিজেপির মতো করে বর্ধমান স্টেশনের নাম পরিবর্তন করতে চাইনি। বরং রাজার ঐতিহ্য কে বাঁচিয়ে ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখতে চাইছি।'


বর্ধমান রাজ আমলে এই শূল ও পুষ্করিণী তৈরী করা হলেও ঠিক কোন রাজার আমলে এটি তৈরী হয়, তা জানা যায়নি। তবে ১৯৭০ এর দশকেও পুকুরের মাঝে শূলটি দেখা যেত বলে জানা যাচ্ছে। রাজ আমলে প্রতিষ্ঠিত এই শূলিপুকুরের নাম  দীর্ঘ কয়েক বছর পর অবশেষে আগামী ৩০ জুলাই পরিবর্তন হতে চলেছে বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদের হাত ধরে। ৩০ জুলাই নবরূপে ওই পুকুরের সৌন্দর্য্যায়নের উদ্বোধন করবেন বিডিএ-র চেয়ারম্যান তথা বর্ধমান দক্ষিনের প্রাক্তন বিধায়ক রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। শূলিপুকুরের নাম পরিবর্তন হয়ে নতুন নামকরণ করা হচ্ছে জীবন সায়র। রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের বিধায়ক উন্নয়ন তহবিলের টাকায় ও বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদের তত্ত্বাবধানে প্রায় ২৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নবরুপে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে বর্ধমানের রাজ ইতিহাসের সাথে যুক্ত শূলিপুকুরকে। 


নাম পরিবর্তন নিয়ে প্রাক্তন বিধায়ক রবিরঞ্জনবাবুর যুক্তি, শূলিপুকুর নামটি স্থূল শব্দ। এই নামের মধ্যে দিয়েই মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখিত হয়। তাই রাজ আমলের কৃষ্ণসায়র, শ্যামসায়রের নামানুসারেই নতুন করে এই পুকুরের নামকরণ করা হয়েছে জীবন সায়র। মৃত্যুর ঠিক বিপরীত। বিডিএ-র উদ্যোগে এই শূলিপুকুরের সংস্কার এবং তার সৌন্দর্য্যায়ন ঘটাতে গিয়ে তাঁরা জানতে পেরেছেন, প্রায় ১৫০ বছর এই পুকুর সংস্কার করা হয়নি। পুকুরে কচুরীপানায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো। যদিও পুকুরের গভীরতা অনেক বেশি। পুকুরের দুটি পাড়ে পাম গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়াও ঐতিহ্য মেনে পুকুরে ৪টি রাজহাঁস ছাড়া হচ্ছে যা সাধারণ মানুষকে আনন্দ দেবে। আস্তে আস্তে গোটা পুকুরে আরও কিছু নতুনত্ব আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।


নাম পরিবর্তনকে স্বাগত জানালেও ইতিহাসের পাতা থেকে শূলিপুকুর নাম মুছবে না বলে অভিমত ইতিহাসবিদ থেকে বর্ধমানবাসীর একাংশের।বর্ধমানের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. সর্বজিত যশ জানিয়েছেন, কবে বা কোন রাজার আমলে এই শূলিপুকুর প্রতিষ্ঠিত হয় তা জানা যায়নি। এমনকি এই পুকুরে যে শূলে কাউকে চড়ানো হয়েছিল, এমন ইতিহাসও মেলে না। তিনি আরও জানিয়েছেন, ১৯৭০-এর দশকেও এই পুকুরের মাঝে শূলটি দেখতে পাওয়া যেত। মানুষকে অপরাধের ভয়াবহতা বোঝাতে এবং অপরাধ থেকে দূরে রাখতেই এই শূল প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মত তাঁর। রাজ আমলে এই পুকুরের পাড়ে ছিল ঘোড়ার আস্তাবল। ঘোড়ারা এই পুকুরে জল খেত। পাশাপাশি শূলিপুকুর নামকরণের মধ্যে দিয়ে একটা নির্মমতা প্রকাশ পেত। তার পরিবর্তে জীবন সায়র নামটি অত্যন্ত যথাযথ। এর মাধ্যমে ইতিহাস মুছে যাবে না। কারণ, মানুষের কাছে ইতিহাস থেকেই যায়। নতুন নামকরণের পরও যে পুরনো ইতিহাস মোছে না, তার প্রমাণ দমদম বিমানবন্দর থেকে মেট্রোর বিভিন্ন ষ্টেশনের নতুন নামকরণ। এমনটাই যুক্তি তাঁর। বর্ধমানের একাংশ প্রবীণ নাগরিকেরাও মনে করেন রাজ আমলে প্রতিষ্ঠিত এই শূলিপুকুরের সাথে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। আছে নানান গল্প কাহিনী তাই এর নাম বদল হলেও শহরবাসীর কাছে তা শূলিপুকুর নামেই পরিচিত থাকবে।