কলকাতা: কেন্দ্রীয় সরকারের শো-কজের জবাব দিলেন পশ্চিমবঙ্গের সদ্য প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আলোচনার পরে রিপোর্ট দিয়ে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে আসি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েই আমরা বেরিয়ে আসি।’
কলাইকুণ্ডায় প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে বিরত থাকার অভিযোগে শো-কজ করা হয় আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের শো-কজের জবাব দিলেন। কেন্দ্রীয় আন্ডার সেক্রেটারি এ কে সিংহকে চিঠি দিলেন তিনি।
৩১ মে ছিল আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাকরির শেষ দিন। সেদিনই তাঁকে দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দিল্লি না গিয়ে সেদিনই অবসর নেন এই আমলা। রাজ্য সরকার তাঁর কর্মজীবনের মেয়াদ তিন মাস বাড়ানোর কথা জানালেও, শেষপর্যন্ত আর বাড়তি সময় চাকরি না করারই সিদ্ধান্ত নেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিনই তাঁকে নিজের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে তিন বছরের জন্য নিয়োগ করার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার থেকেই নতুন ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
মুখ্যসচিব থাকাকালীন গত শুক্রবার আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লিতে বদলি করেছিল কেন্দ্র। সেই নির্দেশ দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর অধীনস্থ কর্মিবর্গ ও প্রশিক্ষণ দফতর। কারণ, আইএএস অফিসাররা এই দফতরের আওতায় পড়েন। যার ভিত্তি ছিল ১৯৫৪ সালের ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাক্টের ৬(১) ধারা। কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রে খবর, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় অবসর নেওয়ার পর কর্মিবর্গ প্রশিক্ষণ দফতর আর এর মধ্যে নেই। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে শোকজ করে অমিত শাহর অধীনস্থ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। হাতিয়ার করা হয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১ (বি) ধারাকে। যেখানে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার বা ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটি বা স্টেট এক্সিকিউটিভ কমিটি বা জেলা কর্তৃপক্ষ বা এদের হয়ে দেওয়া নির্দেশ, কোনও কারণ ছাড়া অমান্য করার অভিযোগে, দোষী সাব্যস্ত হলে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা দু’টোই হতে পারে।
যদিও, এই আইনে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে শোকজ করার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না প্রাক্তন আমলাদের একাংশ। প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও জহর সরকারের মতে, ‘মিটিংটা তো বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে হয়নি। এই আইনে শোকজ কীভাবে?’
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আলাপনবাবুর ক্ষেত্রে যে নোটিস পাঠানো হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মিটিংয়ে যোগদান থেকে বিরত থেকেছেন। বিরত থাকাটা কোনও রিফিউসাল টু কমপ্লাইয়ের মধ্যে পড়ছে বলে মনে হয় না। পরিপ্রেক্ষিতটা দেখতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। দু’জনে মিটিংয়ে বেশিক্ষণ থাকেননি। সেটাও তাঁর নির্দেশেই গেছিলেন। এক্ষেত্রে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ডিরেকশনের অবমাননা করেছেন বলে মনে হয় না। বিরত ছিলেন, তার যথেষ্ট কারণ আছে। দণ্ডনীয় অপরাধ আমি দেখছি না।’
কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, আকাশপথে ঘূর্ণিঝড়-বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনের পর মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত পর্যালোচনা বৈঠক করতে প্রধানমন্ত্রী কলাইকুন্ডায় পৌঁছোন। মিটিং রুমে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা রাজ্যের অফিসারদের জন্য প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষা করেন। এই পরিস্থিতিতে এক আধিকারিক মুখ্যসচিবকে ফোন করে জানতে চান, তাঁরা বৈঠকে যোগ দিতে চান কিনা। তারপর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যসচিব মিটিং রুমে পৌঁছন এবং তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যান।
যদিও, প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মান কিংবা বসিয়ে রাখার অভিযোগ আগেই ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘আমার কপ্টার নামতে দেরি। এটিসি থেকে জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কারণে। ঠিক আছে, কয়েকটা ফাঁকা চেয়ার রাখা হয়, আপনাদের শুধু সেই ছবি দিয়েছে। আমরা যখন কথা বলেছিলাম, সেই ছবি দেয়নি।’
বৈঠক ঘিরে এই টানাপোড়েনের মধ্যেই নতুন বিতর্ক তৈরি করেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে ট্যুইটে তিনি দাবি করেছেন, ‘যে মিথ্যে বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে সোজাসুজি জানাতে চাই, ২৭ মে রাত ১১.১৬-টার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেসেজ করে আমায় বলেন, আমি কি কথা বলতে পারি? জরুরি। তারপর ফোনে তিনি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী থাকলে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পর্যালোচনা বৈঠক বয়কট করতে পারেন।’
তারপর রাজ্যপাল তাঁর ট্যুইটে লিখেছেন, ‘জনসেবাকে হারিয়ে ইগো জিতে গেল।’
এরপর আরেকটি ট্যুইটে রাজ্যপাল লেখেন, ‘বেনজিরভাবে প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং সাংবিধানিক রীতিনীতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ইতিহাসে, ২৮ মে কালো দিন হিসেবে থেকে যাবে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পর্যালোচনা বৈঠকে গণতন্ত্র ছিন্নভন্ন হয়েছে।’
এ নিয়ে রাজ্যপালকে কট্যাক্ষ করেছে তৃণমূল। পাল্টা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে বিজেপি।
সোমবারই মুখ্যসচিব পদ থেকে অবসর নেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরই মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে নিজের মুখ্য উপদেষ্টার পদে নিয়োগ করেন। যা নিয়ে সরব হয়েছে বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ট্যুইট করে বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে অদ্ভুত নাটক চলছে। নিজের ইগোর জন্য ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করে, অনিয়ম সত্ত্বেও মুখ্যসচিবকে বাঁচিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর দফতর এবং ভারতীয় সংবিধানের অসম্মান করছেন। বিদায়ী মুখ্যসচিব মুখ্যমন্ত্রীর কোন গোপন তথ্য জানেন, যে তাঁকে বাঁচাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আকাশ পাতাল এক করে ফেলছেন?’
পাল্টা তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘শুভেন্দু অধিকারীর মুখে এটা শুনতে হবে! শুভেন্দুকে তো আগে অ্যারেস্ট করা উচিত। ও সব বিষয়ে কথা বলছে, শুধু নারদা ছাড়া। নারদ নিয়ে শুভেন্দু বক্তব্য দিন।’
সবমিলিয়ে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যসচিব পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করলেও, তাঁকে ঘিরে সংঘাতের শেষ নেই।