কলকাতা: মুখে কড়া বার্তা আগেই দিয়েছেন। এবার বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলির একাংশের খেয়ালখুশি মতো কাজকর্ম রুখতে কড়া বিল আনছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
চিকিৎসার গাফিলতিতে রোগীর স্বাস্থ্যের অবনতি হোক কিংবা মৃত্যু, অথবা অতিরিক্ত বিল-- বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত যে কোনও অভিযোগের সুরাহার সংস্থান থাকছে এই বিলে। সাধারণ মানুষের অভাব অভিযোগের নিষ্পত্তির জন্য শক্তিশালী কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব থাকছে এখানে।
শুক্রবার বিধানসভায় পেশ হতে চলেছে, দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট (রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) বিল, ২০১৭। যেখানে রোগীদের জন্য রয়েছে একাধিক রক্ষাকবচ। প্রথমেই আসবে বেসরকারি হাসপাতালের গাফিলতিতে রোগীর মৃত্যু বা ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ।
সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত বিলে উল্লেখ রয়েছে--
- গাফিলতির জেরে রোগীর স্বল্প ক্ষতি হলে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমকে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে।
- গাফিলতির জেরে গুরুতর ক্ষতি হলে জরিমানা দিতে হবে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
- আর বেসরকারি হাসপাতালের গাফিলতিতে রোগীর মৃত্যু হলে ন্যূনতম ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
- তবে ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত যে নির্দেশই কমিশন দিক না কেন, তা কোনওভাবেই ৫০ লক্ষ টাকা ছাড়াবে না।
সূত্রের খবর, কতদিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তাও স্পষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে এই বিলে। প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী--
- গাফিলতির জেরে রোগী মৃত্যু হলে ঘটনার ছ’মাসের মধ্যে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
- অন্তর্বর্তী ক্ষতিপূরণ দিলেও, তা দিয়ে দিতে হবে ৩০ দিনের মধ্যে।
বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের রোগ সারাতে আগেই দাওয়াই বাতলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রক বিলের ছত্রে ছত্রেও সেসব দাওয়াইয়েরই ছাপ রয়েছে বলে সূত্রের খবর। শুক্রবার রাজ্য সরকার বিধানসভায় যে বিল পেশ করতে চলেছে, তার ছত্রে ছত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাপ স্পষ্ট। প্রস্তাবিত এই বিলে বলা থাকছে--
- ধর্ষণ, অ্যাসিড হামলা, পথ দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জখম কোনও রোগীকে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে আনা হলে তার আর্থিক সংস্থান না দেখে, আগে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে বিল বাকি থাকলে দেহ আটকে রাখার অভিযোগ বারবার ওঠ। এধরনের অমানবিক ঘটনা এড়াতে এবার তৎপর সরকার। সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত বিলে পরিষ্কার বলা থাকছে--
- টাকার জন্য কারও দেহ আটকে রাখা যাবে না। এমনকী, টাকা না থাকলে জীবনদায়ী ওষুধ কিংবা চিকিৎসাও বন্ধ করা যাবে না।
- প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও যাতে রোগীর পরিবারের ওপর বিলের পাহাড় না চাপে, সেজন্য প্রস্তাবিত বিলে উল্লেখ করে দেওয়া হচ্ছে--
- অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করিয়ে বিলের বহর বাড়ানো যাবে না।
- বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে শয্যার ভাড়া, অপারেশন, পরীক্ষা নিরীক্ষার খরচ বেঁধে দিতে হবে।
- নির্দিষ্ট প্যাকেজের ওপরও বাড়তি খরচ চাপানো যাবে না।
বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম নিয়ে সাধারণ মানুষের আরেকটি খুব পরিচিত অভিজ্ঞতা হল-- অভিযোগ থাকলেও জানানোর জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না। এই প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত বিলে বলে দেওয়া হচ্ছে--
- পরিষেবা, বিল, চিকিৎসা সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর জন্য প্রত্যেক বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে গ্রিভ্যান্স সেল তৈরি করতে হবে।
- আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকেই প্রত্যেক বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ই প্রেসক্রিপশন চালু করতে হবে অনলাইনে মেডিক্যাল রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
যে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে একশোটির বেশি শয্যা রয়েছে, সেখানে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান ও ডায়গোনোসিস সেন্টার চালু করার কথাও বলা হয়েছে প্রস্তাবিত বিলে। এছাড়াও প্রস্তাবিত বিলে উল্লেখ থাকছে--
- বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ইন্ডোর এবং আউটডোরে চিকিৎসা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার খরচ বেঁধে দিতে হবে।
- যে প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারের থেকে জমি বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়েছে, তাদের ২০ শতাংশ আউটডোরের রোগীকে এবং ১০ শতাংশ ইন্ডোরের রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাও দিতে হবে।
শুধুমাত্র ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট আইনকে শক্তিশালী করাই নয়, বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলির ওপর নজরদারির জন্য যে কমিশন তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার হাতেও থাকছে অগাধ ক্ষমতা। প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী--
- গাফিলতির অভিযোগ প্রমাণের পর এই কমিশন কোনও নির্দেশ দিলে, তাকে চ্যালেঞ্জ করে কোনও দেওয়ানি আদালতে যেতে পারবে না সংশ্লিষ্ট বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান। এমনকী, কোনও দেওয়ানি আদালত কমিশনের নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশও দিতে পারবে না।
- প্রস্তাবিত বিলে উল্লেখ থাকছে, এই কমিশনের হাতে যে ক্ষমতা দেওয়া হবে, তা দেওয়ানি আদালতের সমতুল। তাই কমিশনের সামনে যে শুনানি হবে, তা আদালতের সমতুল বলেই গ্রাহ্য হবে।
রাজ্য সরকার আইন করে যে রেগুলেটরি কমিশন তৈরি করতে চলেছে, তাদের হাতে প্রয়োজনে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলি বিরুদ্ধে একাধিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকছে। সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত বিলে উল্লেখ থাকছে--
- বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের গাফিলতির জেরে রোগীর মৃত্যু বা গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রমাণিত হলে কমিশন তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে কিংবা সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারবে।
- এমনকী, প্রয়োজনে সেই বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতাও থাকবে কমিশনের হাতে।
প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী, এই কমিশনের মাথায় থাকবেন হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত অথবা বর্তমান কোনও বিচারপতি কিংবা এমন কোনও অফিসার, যিনি রাজ্যের মুখ্যসচিব বা অতিরিক্ত মুখ্যসচিবের দায়িত্ব সামলেছেন অথবা কেন্দ্রে সমতুল কোনও পদের দায়িত্ব সামলেছেন।
- কমিশনের সর্বোচ্চ ১১জন সদস্য থাকতে পারবেন।
- তারা চিকিৎসা, নার্সিং, আইন, সমাজসেবা, আর্থিক বিষয়ে জড়িত হতে পারেন।
সূত্রের খবর, কমিশনের হাতে আরেকটি ক্ষমতাও দেওয়া হচ্ছে। প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী --
- কারও গাফিলতিতে রোগীর মৃত্যু বা ক্ষয়ক্ষতির কথা প্রমাণিত হলে তার নাম, ঠিকানা এবং জরিমানার পরিমাণ, তারই খরচে সংবাদপত্রে ছাপাতে পারবে কমিশন।
- এই আইন কার্যকর হলে, গাফিলতির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তির বিরুদ্ধেও একই রকম কড়া পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত বিলে উল্লেখ থাকবে--
- কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত বিধি না মানার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
- কারও গাফিলতিতে রোগীর মৃত্যু বা ক্ষয়ক্ষতি হলে, ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী তার শাস্তি হবে।
এই আইন কার্যকর হলে তার আওতায় আসবে --
- বেসরকারি হাসপাতাল
- ম্যাটারনিটি হোম
- নার্সিংহোম
- ডিসপেনসারি
- ক্লিনিক
- পলিক্লিনিক
- স্যানেটোরিয়াম
- ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি
- ফার্টিলিটি ক্লিনিক