দার্জিলিঙ ও উত্তর ২৪ পরগনা:  দার্জিলিঙে গুরুং-সঙ্গীদের হাতে খুন পুলিশ অফিসার। শুক্রবার ভোরে সিংলার জঙ্গলের মধ্যে গুরুঙের ডেরার কাছাকাছি পৌঁছতেই পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে তাঁর অনুগামীরা। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দার্জিলিং থানার সাব ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিকের। পাল্টা গুলি চালায় পুলিশ। চম্পট দেন গুরুং। উদ্ধার একাধিক একে ফর্টিসেভেন-সহ প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং বিস্ফোরক।
রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং ইউএপিএতে অভিযুক্ত মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুং বৃহস্পতিবার বার্তা দেন, ৩০ অক্টোবর তিনি প্রকাশ্যে আসবেন। এরইমধ্যে পুলিশও মোবাইল ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে জানতে পারে, গুরুং তার দেহরক্ষীদের নিয়ে সিকিম থেকে দার্জিলিঙে ঢুকে পড়েছেন। লুকিয়ে রয়েছেন জঙ্গলে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যাম্প তৈরি করেছেন। রাজ্যের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা বলেন, স্পেশিফিক ইনফরমেশন ছিল, গুরুং তার পারসোনাল বডিগার্ড এবং কিছু অ্যান্টিসোশালদের নিয়ে শিরুবাড়ি জঙ্গলে লুকিয়ে রয়েছে।
গুরুংয়ের হদিশ পেয়েই বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান শুরু করে রাজ্য পুলিশ। অন্ধকারের বুক চিরে এগোতে থাকে পুলিশ বাহিনী! রাত ২টো নাগাদ তারা পৌঁছে যায় লাপচে বস্তিতে। গাড়ি নিয়ে যাওয়ার মতো রাস্তা নেই! তাই দার্জিলিঙের আইজি মনোজ বর্মার নেতৃত্বে পায়ে হেঁটেই এগোতে থাকে পুলিশ বাহিনী।
শুক্রবার, ভোর পাচটা সিকিম সীমানা লাগোয়া শিংলার জঙ্গলে ঢোকে পুলিশ বাহিনী। জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই বয়ে গিয়েছে নদী। যার একদিকে সিকিম। আরেকদিকে দার্জিলিং। পুলিশের কাছে খবর ছিল, এই জঙ্গলেই দল বেঁধে ঘাঁটি গেড়ে রয়েছেন বিমল গুরুং।
পুলিশ সূত্রে দাবি, বাহিনী জঙ্গলে ঢুকতেই তাদের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে গুলি! গুলি চালাতে শুরু করে গুরুংপন্থীরা। পাল্টা জবাব দেয় পুলিশও। পুলিশের দাবি, গুলির লড়াইয়ের ফাঁকেই বিমল গুরুংকে নিয়ে নদী পেরিয়ে চম্পট দেয় তাঁর বডিগার্ডরা। পালাতে পালাতে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় তারা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সাব ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিকের। অনুজ শর্মা বলেন, পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। সাব ইন্সপেক্টরের মৃত্য হয়েছে। ২ জন আহত।
পুলিশ জানিয়েছে, শিংলার জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে গুরুং অনুগামীদের ফেলে যাওয়া বেশ কয়েকটি একে ৪৭ রাইফেল। এছাড়া, রিভলভার, বোমা, জিলেটিন স্টিক উদ্ধার করেছে পুলিশ! উদ্ধার হয় প্রায় প্রচুর কার্তুজ। লিম্বু বস্তির কাছে পুলিশের একটি রিকভারি ভ্যানেও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। গুরুতর জখম গাড়ির চালকে ভর্তি করা হয়েছে দার্জিলিং সদর হাসপাতালে।
বছর আঠাশের অমিতাভ মধ্যমগ্রামের ছেলে। মধ্যমগ্রাম বয়েজ হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পড়াশোনায় বরাবরই ভাল। মুম্বইয়ে অটোমোবাইল ডিজাইনিং কোর্সে সুযোগও পেয়েছিলেন অমিতাভ।
কিন্তু বাবা সামান্য কারখানার কর্মী হওয়ায় মুম্বইয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি। সংসারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই অমিতাভ চাকরি খুঁঝতে শুরু করে। পেয়েও যায় পুলিশে। পুলিশে প্রশিক্ষণের সময় চাকরি পান ব্যাঙ্কে। কিন্তু, সেই চাকরিতে যাননি অমিতাভ। কারণ, ছোটবেলা থেকেই তাঁকে টানত খাকি উর্দি। মৃত পুলিশকর্মীর বাবা সৌমেন মালিক বলেন, পুলিশের ইউনিফর্ম পড়ার ইচ্ছে ছিল ওর।
২০১৫ সালে সাব ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিকের পোস্টিং হয় দার্জিলিঙে। এ বছর মার্চ মাসে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে নিয়ে দার্জিলিঙেই থাকতেন। স্বামীর সাদা কাপড়ে মোড়া নিথর দেহটা ছাড়তেই চাইছিলেন না স্ত্রী। বারবার টেনে তোলার চেষ্টা করেও তোলা যাচ্ছিল না! বারবার যেন একটাই কথা জিজ্ঞাসা করছিল, কথা তো ছিল সাত জন্মের, মাত্র ৬ মাসেই কী করে সব শেষ হয়ে গেল?
মৃত সাব ইন্সেপেক্টরের বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। সৌমেনবাবু জানান, মুখ্যমন্ত্রী পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন দোষীদের শাস্তি হবে। ছেলে বলে গিয়েছিল, কালীপুজোর ছুটিতে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ছেলে আসবে বলে আর তর সই ছিল না মায়ের। কিন্তু, আচমকাই সব শেষ। ছেলে এল না। এল তাঁর মৃত্যু সংবাদ। মৃত সাব ইন্সপেক্টরের মা গঙ্গা মালিক কাঁদতে কাঁদতে একটাই দাবি করেন। যারা এরকম করেছে তাদের শাস্তি চাই।
উত্তরের শহরতলি থেকে সুদূর উত্তরে গিয়েছিল অমিতাভ। সেখানেই সব শেষ। অনুজ শর্মা বলেন, এক সাহসী পুলিশ অফিসারের মৃত্যু হল।