কলকাতা: নাগাড়ে বৃষ্টিতে জলবন্দি আসানসোল-দুর্গাপুরের অসংখ্য মানুষ। পুরুলিয়া-আসানসোলে কাচা বাড়ি, দেওয়াল ভেঙে মৃত ৩, আহত বেশ কয়েকজন।
ক’দিন ধরেই নাগাড়ে বৃষ্টি। আসানসোলের রাস্তা যেন নদী। কোথাও হাঁটু সমান তো, কোথাও গলা পর্যন্ত। মঙ্গলবার সকালে হঠাৎই গাড়ুই নদীর জল উপচে প্লাবিত হয়ে পড়ে রামকৃষ্ণনগরের বিস্তীর্ণ এলাকা। একতলা বাড়িগুলি প্রায় ডুবে যাওয়ার অবস্থায়। ভিতরে আটকে পড়ে বহু মানুষ।


উদ্ধার করতে গিয়ে রীতিমতো বেগ পেতে হয় দমকলকে। দোতলার ছাদে উঠে সেখান থেকে পাশের একতলার ছাদে মই ঠেলে দেন দমকলকর্মীরা। এরপর সেই মই বেয়ে একে একে নিরাপদ স্থানে উঠে আসেন জলবন্দি মানুষজন।


বিরামহীন বৃষ্টিতে জল থৈ থৈ রানিগঞ্জ স্টেশন চত্বর। জল ঢুকে গিয়েছে টিকিট কাউন্টারেও। কুলটির প্রিয়া কলোনিতে জলবন্দি কয়েকশো মানুষ। জলের নীচে কালনা, দোমোহানি, মহাবীর কোলায়ারি-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। পুরসভার গলায় নিরুপায় সুর। এরই মাঝে আসানসোলের গোধুলি মোড়ে দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যু হয় এক মহিলার।


একটানা বৃষ্টিতে পশ্চিম বর্ধমানের বর্ধমানের দুর্গাপুরেও বেহাল দশা। দুর্গাপুর পুরসভার ৪৩টির মধ্যে ১০টি ওয়ার্ড জলের নীচে। জমা জলের প্রভাব পড়েছে শিল্পতালুকেও।ধস নেমেছে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে নবনির্মিত সার্ভিস রোডে। ব্যাহত পানাগড়-দুর্গাপুর যান চলাচল।


লাগাতার বৃষ্টিতে ফুঁসছে কংসাবতী নদী। আদ্রার বেনিয়াশোল, কাশীপুর থানার রঙ্গিলাডি-সহ জলমগ্ন পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। জলের নীচে বিঘার পর বিঘা ফসল। জলবন্দি হাজার হাজার মানুষ। ভেঙে পড়েছে ৪২টি কাচা বাড়ি। শিশু, মহিলা-সহ আহত বেশ কয়েকজন। এদিকে, জলের তোড়ে বরবরা, রঞ্জনডি, কোড়াডি সেতু ভেঙে সদর শহরের সঙ্গে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।


প্রবল বৃষ্টিতে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে অটোর ওপর ভেঙে পড়ল পুরনো বাড়ির দেওয়াল। মৃত এক কিশোর-সহ ২। আহত ৫। তাঁদের মধ্যে ৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জানা গিয়েছে, আদ্রা-রঘুনাথপুর রুটে অটো চালান স্থানীয় বাসিন্দা সোনু খান।


মঙ্গলবার সকাল ৯টা নাগাদ খালি অটো নিয়ে নান্দোয়ারা এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। বর্ষার রাস্তায় কাদামাটিতে বসে যায় অটোর পিছনের দুটি চাকা। অটো থেকে নেমে চাকা তোলার চেষ্টা করছিলেন চালক। সাহায্যে এগিয়ে আসেন এক কিশোর-সহ স্থানীয় যুবকরা। সেইসময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক মহিলা। আচমকাই একটি বাড়ির দেওয়াল তাঁদের ওপর ভেঙে পড়ে।


গুরুতর জখম হন ওই মহিলা পথচারী ও অটোচালক-সহ ৭ জন। তাঁদের উদ্ধার করে রঘুনাথপুর সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ১২ বছরের এক কিশোর-সহ ২ জনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। ঘটনায় আহত ৫ জনের মধ্যে ৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদের মধ্যে ৩ জনকে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।


বর্ষায় বেহাল দশা বীরভূমও। জলবন্দি সিউড়িতে ময়ূরাক্ষীর কোলে থাকা প্রায় ১৫টি গ্রাম। শহরে যেতে গেলে একমাত্র মাধ্যম নৌকো। কিন্তু, সেখানেও রয়েছে সঙ্কট। কারণ, পনেরোটি গ্রামের সম্বল এই একটিই নৌকো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে তাতে চড়েই সকলকে পৌঁছতে হয় গন্তব্যে।


একটানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত বাঁকুড়া। কোথাও সেতুর ওপর দিয়ে বইছে জল। কোথাও খালের জল ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে পিচের রাস্তার নীচের অংশ। প্রায় বিচ্ছিন্ন দুর্গাপুর ও ঝাড়গ্রামের সঙ্গে বাঁকুড়ার যোগাযোগ। সোমবার কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টি থামায় জলস্তর একটু হলেও নেমেছিল। স্বস্তি পেয়েছিলেন স্থানীয়রা।


কিন্তু, রাতে বৃষ্টি শুরু হতেই ফের ফুঁসে ওঠে গন্ধেশ্বরী। সেতুর ওপর নদীর স্রোত এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাস্তার একটা অংশ ভেঙে ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। শুধু দুর্গাপুরের দিক থেকে নয়, ঝাড়গ্রামের সঙ্গেও বাঁকুড়ার যোগাযোগ এখন প্রায় বিচ্ছিন্ন। কারণ বৃষ্টিতে ভগ্নপ্রায় এই রাস্তা।


বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রামের মধ্যে সংযোগকারী ৯ নম্বর রাজ্য সড়কের একটি অংশ গিয়েছে বিড়াই খালের ওপর দিয়ে। একনাগাড়ে বৃষ্টিতে খালের স্রোত এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা রাস্তার নীচের মাটি ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে। গাড়ি তো দূরের কথা, হেঁটে চলাচলও বন্ধ। বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রামের দিক থেকে ব্যারিকেড করে রাস্তা আটকে দেওয়া হয়েছে, যাতে কেউ ভুল করেও এদিকে না চলে আসেন।


অন্যদিকে, বাঁকুড়ার মেজিয়াতেও জাতীয় সড়কে ধস নেমেছে। মঙ্গলবার ভোরে তারাপুরের কাছে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের একটি অংশ বসে যায়। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। টানা বৃষ্টিতে জলমগ্ন চন্দ্রকোণা-ঘাটালের বিস্তীর্ণ এলাকা। বিপর্যস্ত জনজীবন।


লাগাতার বৃষ্টিতে পশ্চিম মেদিনীপুরে জল বাড়ায় যখন চরম সঙ্কটে বাসিন্দারা, তখন পূর্বে জল কিছুটা নামলেও, দেখা দিয়েছে জল বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। লাগাতার বৃষ্টির জেরে পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণায়। জল আরও বেড়েছে। ভেঙে পড়েছে বহু বাড়ি। আশ্রয় হারিয়ে দিশাহারা, হাজার হাজার মানুষ।


চন্দ্রকোণায় বহু জায়গাতেই এখন যেতে হলে নৌকা ছাড়া কোনও গতি নেই। একই অবস্থা ঘাটালেও। বাঁধ ভেঙে জলের নীচে বিস্তীর্ণ এলাকা। রাস্তার উপর দিয়ে বইছে জল। চন্দ্রকোণা-ঘাটাল সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।


পশ্চিম মেদিনীপুরে যখন জল বাড়ছে, তখন ঠিক তার উল্টো ছবি পূর্ব মেদিনীপুরে। তবে, জল নামার সঙ্গে সঙ্গে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে হলদিয়ায়। বাসিন্দাদের দাবি, কারখানা থেকে নির্গত বজ্রপদার্থ বৃষ্টির জলে ভেসে এসে মিশেছে রাস্তায় জমা জলের সঙ্গে। যার জেরে ঘরে ঘরে জ্বর-অ্যালার্জি-পেট ও মাথা ব্যথার প্রকোপ।


চারদিকে জল, কিন্তু খাওয়ার জল নেই! হলদিয়ায় এখন পানীয় জলের সঙ্কট। পরিস্থিতি সামাল দিতে সবরমকমের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে দাবি হলদিয়া পুরসভার। হলদিয়ায় যখন জলকষ্ট, রোগের প্রাদুর্ভাব, তখন জলমগ্ন নন্দীগ্রাম, পাঁশকুড়া, তমলুক, এগরা, ময়না-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা।


সমুদ্র উত্তাল থাকায় মঙ্গলবারও পর্যটকদের সমুদ্রে নামতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মৎস্যজীবীদেরও সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।