সোমা মুখোপাধ্যায় ও অভিজিৎ চক্রবর্তী


মুড়ি তাঁর বড় সাধের খাবার। নবান্ন হোক বা নিজের বাড়ি, শহরে অথবা জেলা সফরে, মুখ্যমন্ত্রীর খাবারের তালিকায় মুড়ি থাকবেই। শোনা যায়, বিদেশ সফরেও নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাগে বড়সড় মুড়ির প্যাকেট থাকে। শুধু নিজে খাওয়া নয়, অন্যকেও মুড়ি খেতে প্রায় সাধাসাধি করেন তিনি।


এ হেন সাধের মুড়িতে মিশছে ইউরিয়া! সারের দোকান থেকেই তা কিনে আনছেন উৎপাদকেরা। আর দিনের পর দিন এই রাসায়নিক শরীরে ঢুকে় তৈরি করছে নানা ধরনের স্বাস্থ্য-সমস্যা।

মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য একাধিক বার জানিয়েছেন, ফোলা-মুচমুচে, ইউরিয়া দেওয়া মুড়ির মোহ তাঁর নেই। তাঁর জন্য জেলা থেকে ঘরে ভাজা মুড়ি আসে। হোক না সে মুড়ি লালচে এবং সরু। তবু তো তা নিরাপদ!

কিন্তু বাজারে এখন সাদা ধবধবে, ফোলা মুড়ি ছাড়া অন্য মুড়ি কার্যত পাওয়াই যায় না। চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘদিন এই বিষ শরীরে গেলে তার পরিণতি হতে পারে মারাত্মক।

এক সময় রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় গ্রামে গ্রামে মুড়ি ভাজা হতো। প্রতি কিলো ভেজা চালে ৪০ গ্রাম নুন মিশিয়ে শুকনো করে বালিতে ভেজে নেওয়া হতো। এখন আধুনিক যন্ত্রে মুড়ি ভাজা হয়। তাতে প্রতি দিন ৩০-৪০ কুইন্ট্যাল মুড়ি তৈরি হয় একেকটি কারখানায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের এক ব্যবসায়ী জানালেন, ইউরিয়া না-মেশালে প্রতি কুইন্ট্যাল মুড়ি তৈরিতে গড়ে ৩০০-৪০০ টাকার জ্বালানি খরচ হয়। কিন্তু ইউরিয়া মিশ্রিত চালে জ্বালানির খরচ অর্ধেক হয়ে যায়। সাদা ও ফুলকো মুড়ি বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকায়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা সেই মুড়ি খদ্দেরদের বিক্রি করেন ৪০-৪৫ টাকায়।

বর্ধমানের কালনার এক মুড়ি ব্যবসায়ীর স্বীকারোক্তি, তাঁদের এলাকায় প্রায় সব ব্যবসায়ীই মুড়িতে ইউরিয়া মেশান। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতিযোগিতার বাজার। কম সময়ে বেশি জিনিস তৈরি করতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই। মুখে সকলেই অস্বীকার করবেন, কিন্তু লুকিয়ে সকলেই বেআইনি কাজটা করেন।’’



পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছেন ইদানীং জেলার অনেক বাসিন্দাই বিষের হাত থেকে বাঁচতে নিজেরা চাল কিনে নিয়ে গিয়ে কারখানায় মুড়ি তৈরি করিয়ে আনেন। তাঁরা ইউরিয়া মেশাতে দেন না। কিন্তু শহরে সে সুযোগ কই? সেখানে তো ভরসা প্যাকেট-বন্দি মুড়িই। সেই প্যাকেটে যে ইউরিয়া নেই, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন না।

রসায়নের শিক্ষক কৌশিক ঘোষের ব্যাখ্যা, ইউরিয়া একটি নাইট্রোজেন ঘটিত বর্জ্য পদার্থ। প্রোটিন জাতীয় খাদ্য বিপাকের ফলে মানবদেহে এমনিতেই ইউরিয়া উৎপন্ন হয়। সেই ইউরিয়া রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে কিডনির সাহায্যে পরিস্রুত হয়ে প্রস্রাব ও ঘামের সঙ্গে দেহ থেকে বেরিয়েও যায়। কিন্তু খাবারের সঙ্গে ফের অতিমাত্রায় ইউরিয়া ঢুকলে রক্তে ইউরিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। তখনই শরীরে নানা প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, ‘‘এমনিতেই মানবশরীরে প্রতি ডেসিলিটারে ৭-২০ মিলিগ্রাম ইউরিয়া থাকে। কিন্তু বেশি মাত্রায় ইউরিয়ায় কিডনি থেকে পাকস্থলী, সর্বত্র প্রভাব পড়ে। দেখা যায় নানা উপসর্গ।’’ যেমন তলপেটে যন্ত্রণা, দুর্বলতা, পেশিতে টান। মেডিসিনের চিকিৎসক শোভন দাস বলেন, “ইউরিয়ার মাত্রা বেশি থাকলে ক্যানসার পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে। হার্টের সমস্যাও তৈরি হয়। এক কথায় শরীরের

নানান অঙ্গকে বিকল করে দেয় মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া।”

গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী জানিয়েছেন, টানা বহু দিন খাবারের সঙ্গে ইউরিয়া শরীরে গেলে কিডনির সমস্যা, রক্তের সমস্যা, লিভারের সমস্যা সব কিছুই হতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘বাইরে থেকে শরীরে যা ঢোকে তাকে শরীরের পক্ষে উপযোগী করে তোলে লিভার। যাতে খারাপ অংশ বেরিয়ে যায় আর ভাল অংশ ভেতরে থাকে। এটা করতে গিয়ে লিভার নিজেই নীলকণ্ঠ হয়ে থাকে। ইউরিয়া যখন শরীরে ঢোকে, তখন তা লিভারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে বেশি।’’

চিকিৎসকদের বক্তব্য, যাঁদের এমনিতেই কিডনির সমস্যা রয়েছে,

ইউরিয়া দেওয়া মুড়ি খেলে তাঁদের কিডনি আরও খারাপ হয়। ডায়ালিসিস করানোর প্রয়োজন আরও ত্বরান্বিত হয়। নেফ্রোলজিস্ট অভিজিৎ তরফদারের কথায়, ‘‘কিডনির কাজ শরীর থেকে ইউরিয়া বার করে দেওয়া। শরীরে যদি বাড়তি ইউরিয়া জমতে থাকে, তা হলে কিডনির চাপ বাড়ে। কিডনি পুরো ইউরিয়া বার করতে পারে না।’’ অতিরিক্ত ইউরিয়ায় ‘ইউরেনিক সিম্পটম’ বা বমিভাব, অবসাদ দেখা দেয়। ঘুম খুব কমে যায় বা অতিরিক্ত বেড়ে যায়।

দিনের পর দিন শরীরে এমন বিষ ঢুকছে, অথচ প্রশাসনের কি সে দিকে নজর নেই? খাদ্য সুরক্ষা দফতরের কর্তারা স্বীকার করেছেন, রাজ্যের পারফরম্যান্স খুব খারাপ। হাতে গোনা কয়েক জন অফিসার। তা দিয়ে তাঁরা কী করবেন? দফতরের এক কর্তার স্বীকারোক্তি, ‘‘আমাদের যা পরিকাঠামো, তাতে আক্ষরিক অর্থেই ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছি। কোনও কিছুতেই নজরদারির উপায় নেই।’’ ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়া-ও জানিয়েছে, প্রতি বছর তারা বিভিন্ন রাজ্য থেকে পরীক্ষিত খাবারের যে নমুনা পায়, তাতে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যা খুবই কম।

তা হলে উপায়?

চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, দোকানে গিয়ে লালচে মুড়ি চান। অন্য মুড়ি কেনা একেবারে বন্ধ করে দিন। সবাই সচেতন ভাব‌ে এই কাজ করলে লালচে মুড়ি বাজারে ফিরতে বাধ্য। সেই সঙ্গে আরও একটি আশার আলো। সম্প্রতি সার্বিক ভাবেই ইউরিয়ার অপব্যবহার ঠেকাতে নিমের মোড়কে ইউরিয়া তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। চাষের জন্য ভর্তুকি দেওয়া ইউরিয়া সস্তায় মেলে বলেই চাষের বাইরে অন্যান্য শিল্পে তার ব্যবহার হয়। ইউরিয়াতে নিম মেশানো থাকলে তা মুড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ তা হলে মুড়ি এমনই তেতো হবে যে তা খাওয়া যাবে না।