পার্থপ্রতিম ঘোষ, প্রকাশ সিনহা ও আবীর দত্ত, কলকাতা: পরপর গুলি! ছুটে যাচ্ছেন পুলিশ অফিসাররা। দু’তরফ থেকেই নাগাড়ে চলছে গুলিবর্ষণ! জম্মু কাশ্মীর বা কোনও মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা নয়, আজ হাড় হিম করা এই শ্যুটআউটের ছবি নিউটাউনের। পুলিশ-দুষ্কৃতী গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হল দুই গ্যাংস্টারের। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের এক পুলিশ অফিসার।


নিউটাউনের সাপুরজি আবাসনে লুকিয়ে রয়েছে পঞ্জাবের কুখ্যাত গ্যাংস্টার জয়পাল ভুল্লার। গোপন সূত্রে এই খবর পেয়ে স্পেশাল অপারেশন শুরু করে বিধাননগর পুলিশের এসটিএফ। আজ দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ সাপুরজি আবাসনের বি ব্লকের গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে স্পেশাল পুলিশ ফোর্স। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, হঠাত্‍ই পাঁচতলার ওপরের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি ও তার পাশের লবি থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে গ্যাংস্টাররা। শান্ত আবাসনে হঠাৎ‍ই গুলির লড়াইয়ে চমকে ওঠেন সাপুরজি আবাসনের বাসিন্দারা। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও, পাল্টা গুলি চালান এসটিএফ-এর অফিসাররাও। দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় গুলির লড়াই। গুলির আওয়াজে তখন কান পাতা দায়। এরপর গোটা আবাসন ঘিরে ফেলেন অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের জওয়ানরা। একনজরে দেখলে তখন মনে হতে পারে, শ্রীনগরে আর্মির কোনও স্পেশাল অপারেশন চলছে। শ্যুটআউটে মৃত্যু হয় পঞ্জাবের কুখ্যাত গ্যাংস্টার জয়পাল ভুল্লার ও জসপ্রীত সিংহ জাসসির। কার্তিকমোহন ঘোষ নামে স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের এক পুলিশ অফিসারের ডান কাঁধ ফুটো করে বেরিয়ে যায় গুলি। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসে পরিস্থিতি। 


মুহুর্মুহু গুলি চলছে। রাইফেল হাতে দৌড়চ্ছে পুলিশ! গুলির লড়াইয়ের মধ্যেই আহত এক পুলিশ অফিসারকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সহকর্মীরা। গোটা হাউজিং কমপ্লেক্স যেন যুদ্ধক্ষেত্র! এই সব দৃশ্য আগে কোনওদিন দেখেছে কলকাতা? টানটান এক ক্রাইম থ্রিলার। পুলিশের গোপন অপারেশনের প্লট! ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৮, দিল্লির জামিয়া নগরে কুখ্যাত বাটলা হাউজ এনকাউন্টারের কথা মনে করিয়ে দিল নিউটাউনের এই ঘটনা। ২০০৮-এর ১৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পরই বাটলা হাউসে অভিযান চালায় দিল্লি পুলিশের ৭ সদস্যের স্পেশাল সেল। গোপন ডেরায় ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের জঙ্গিরা লুকিয়ে আছে, এই খবর এসেছিল পুলিশের কাছে। সেই মতো ১৯ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার সময় বাটলা হাউসে শুরু হয় অভিযান। সেদিন গুলির লড়াইয়ে ২ জঙ্গির পাশাপাশি মোহনচাঁদ শর্মা নামে দিল্লি পুলিশের ইন্সপেক্টরের মৃত্যু হয়। নিউটাউনে গ্যাংস্টার জয়পাল ভুল্লর আর যশপ্রীত জসসিকেও কার্যত ঘিরে ফেলেছিল এসটিএফ। কিন্তু গুলি বিনিময়ে আহত হন এক পুলিশ অফিসার। এসটিএফ-এর অফিসারদের হাতে ছিল হেকলার অ্যান্ড কচ এমপি ৫। জার্মানিতে তৈরি সাব মেশিনগান। এছাড়াও অফিসারদের হাতে ছিল আমেরিকার তৈরি গ্লক পিস্তল। এক অফিসারকে আহত হতে হলেও, এই অভিযানে শেষপর্যন্ত সফল হয় বিধাননগর পুলিশের এসটিএফ।


পুলিশ সূত্রে খবর, নিহত দু’জনেই পঞ্জাবের বাসিন্দা। তারা কুখ্যাত গ্যাংস্টার। ৪০টিরও বেশি মামলায় তাদের খুঁজছিল পুলিশ। পুলিশ সূত্রে খবর, ২২ মে থেকে এই আবাসনে আত্মগোপন করেছিল দুই গ্যাংস্টার। কিন্তু, শেষরক্ষা হল না। এসটিএফ-এর হাতেই মৃত্যু হল দু’জনের।


গোটা ঘটনায় বারবার উঠে আসছে একটা নাম, জয়পাল সিংহ ভুল্লার ওরফে মনোজিৎ সিং। সে অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টরের ছেলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র, নাম করা অ্যাথলিট এবং সবশেষে গ্যাংস্টার! কোন পরিচয় পায়নি এই ভুল্লার! কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে পঞ্জাব পুলিশের ডায়েরিতে গ্যাংস্টার হিসেবেই পরিচিত ছিল সে। পুলিশ সূত্রে দাবি, গত ১৫ মে লুধিয়ানায় গুলি করে খুন করা হয়েছিল পঞ্জাব পুলিশের দুই এএসআই-কে। সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পঞ্জাব হোম গার্ডের এক জওয়ানের দাবি, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল এই ভুল্লারই। তারপর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছিল সে।


সূত্রের খবর, এরপরই কলকাতা পুলিশকে তার সম্পর্ক জানায় পঞ্জাব পুলিশ। আজ এনকাউন্টারে মৃত্যু হল সেই ভুল্লার ও তাঁর সঙ্গী জসপ্রীত সিং জাসসির। পুলিশ সূত্রে দাবি, ২০১৬ সালে পঞ্জাবের ভাটিন্দারে শের খুব্বা নামে ভুল্লারের এক বন্ধু এনকাউন্টে মারা যান। এর বদলা নিতে ওই বছরেই হিমাচল প্রদেশে যশবিন্দর সিংহ রকি নামে অপর গোষ্ঠীর গ্যাংস্টারকে খুন করে এই ভুল্লার। হিমাচল প্রদেশেই ৪০-এর বেশি খুন, তোলাবাজি, অপহরণের অভিযোগ ছিল তার নামে। তাছাড়াও পাতিয়ালাতে একটি ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনাতেও নাম জড়ায় ভুল্লারের। এছাড়াও একটি ব্যাঙ্ক থেকে ৩০ কেজি সোনা লুঠেরও অভিযুক্ত ছিল সে। একজন পুলিশ কনস্টেবলের ছেলে কীভাবে ডন হয়ে উঠতে পারেন, তা দাউদ ইব্রাহিমের জীবনে দেখে জানতে পেরেছে গোটা বিশ্ব। সবাই ডন হয় না। কিন্তু একজন পুলিশের ছেলে কীভাবে গ্যাংস্টার হয়ে উঠতে পারে, তার হাতেগরম উদাহরণ এই জয়পাল সিংহ ভুল্লার। সেও একজন অবসরপ্রাপ্ত এএসআই-এর ছেলে। শুধু তাই নয়, খেলাধুলাতেও পারদর্শী ছিল ভুল্লার। যে হাত তাকে একসময় হ্যামার থ্রোয়ার হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিল, পরে সেই হাতেই একসময় উঠে আসে আগ্নেয়াস্ত্র! যা থেকে বেরিয়ে আসা গুলিতে বুধবার জখম হলেন এসটিএফ-এর অফিসার।