কলকাতা: মাঝে এক বার অন্য রকম ঘটেছিল। তার জের কাটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতি পড়ে থাকল বয়কট-তত্ত্বেই।

ভোটের পরে শাসক দলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে শুক্রবার নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান বয়কট করল বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও রাজ্য বিজেপি। শাসকের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ থাকেই। কিন্তু নতুন মন্ত্রিসভার শপথের মতো সাংবিধানিক অনুষ্ঠানে বিরোধীদের গরহাজিরা গণতন্ত্র সম্পর্কেই ভুল বার্তা দেয়। সেই সূত্রেই বিরোধীদের এই সিদ্ধান্তে ফের প্রশ্ন উঠে গেল, সরকারকে বয়কট করতে গিয়ে জনাদেশকেই কি তাঁরা অসম্মান করলেন না?

বিধানসভায় তৃণমূল এ বার পেয়েছে দু’কোটি ৪৫ লক্ষ ভোট। আর বিরোধী জোট পেয়েছে দু’কোটি ১৫ লক্ষ। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু দু’কোটি ৪৫ লক্ষ মানুষের মুখ্যমন্ত্রী নন। তাঁর শপথ অনুষ্ঠান থেকে সরে দাঁড়িয়ে বিরোধীরা নিজেদের ভোটারদের প্রতিও যথাযথ মর্যাদা দেখালেন কি না, উঠে যাচ্ছে সেই প্রশ্নও।

তবে এ রাজ্যে বিরোধীদের বয়কট-নীতি একেবারেই নতুন নয়। মহাজোট গড়ে পরাস্ত হওয়ার পরে ২০০১ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে যাননি বিরোধীরা। এমনকী, তার কয়েক মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে জ্যোতি বসুর বিদায় উপলক্ষে বিধানসভার অনুষ্ঠানেও যাননি তৎকালীন বিরোধীরা। আবার ২০০৬ সালে আমন্ত্রিত হয়েও মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর শপথে ছিলেন না মমতা। শুধু ২০১১ সালে রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রী মমতার শপথ অনুষ্ঠানে হাজির থেকে সৌজন্যের বার্তা দিয়েছিলেন সদ্যপ্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু এবং বাম নেতারা। এ বার আবার বিরোধী রাজনীতি ফিরে গেল পুরনো ছকে! যে ছকে বিরোধী নেত্রী মমতা দিনের পর দিন সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট করতেন। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, সেই পথে থেকে মমতা ভোটে সফল হয়েছেন! অথচ গত পাঁচ বছর বয়কটে না গিয়ে বিরোধীরা কোনও সুফল পাননি।

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির নেতৃত্বে বিজেপি-র প্রতিনিধিদল কিন্তু এ দিনের অনুষ্ঠানে এসেছিল। সঙ্গে এ রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। পূর্ব মেদিনীপুরে এ দিনই আজাদ শেখ নামে এক বিজেপি কর্মী তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ। সম্প্রতি কাকদ্বীপে আক্রান্ত হয়েছেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। সন্ত্রাসের প্রতিবাদে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব শপথে না গেলেও কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব মুখ ফিরিয়ে নেননি। জেটলি বলেছেন, ‘‘একটি সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোয় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে এসেছিলাম। যদিও রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলের বিরোধিতা করছি।’’ সম্প্রতি বিহারে নীতীশের শপথ অনুষ্ঠানও বয়কট করেনি বিজেপি। সেখানে অবশ্য সন্ত্রাস নিয়ে এমন তিক্ততা দুই যুযুধান পক্ষের ছিল না।

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের যুক্তি, সরকার পক্ষ সন্ত্রাস বন্ধে পদক্ষেপ করেনি শুধু নয়। সন্ত্রাস বলে কিছু হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছে। সূর্যবাবুর কথায়, ‘‘জাঁকজমক করে মন্ত্রিসভা যখন শপথ নিচ্ছে, সে দিনই হলদিয়ার বিধায়ক তাপসী মণ্ডলের বাড়িতে বোমা পড়ছে!’’ সিপিএমের বিধায়ক সুজন চক্রবর্তীরও বক্তব্য, ‘‘জনাদেশ মেনে নিয়েছি। তার পরেও যে ভাবে আমাদের কর্মীদের উপরে হামলা হচ্ছে, তাতে কোটি টাকা ব্যয়ের এই শপথ-উৎসবে অংশ নেওয়ার মানসিকতা আমাদের ছিল না।’’ বিধায়ক হিসাবে তাঁর কাছে কোনও আমন্ত্রণপত্র আসেনি বলেও সুজনবাবু জানিয়েছেন।

একই ভাবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ নয়। বিরোধীদের উপরে সন্ত্রাসের প্রতিবাদেই শপথে যাইনি।’’ দলের বর্ষীয়ান বিধায়ক আব্দুল মান্নানেরও এক সুর, ‘‘মমতা যে ভাষায় কথা বলেন, সেই ভাষাতেই তাঁকে জবাব দিয়েছি!’’ জেটলি-বাবুলের অনুষ্ঠানে যাওয়াকে ‘গট-আপ’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।