গুড়াপ:থেমে গেল সুরের সফর! আর গলা ছেড়ে গাইবেন না তিনি! চলে গেলেন দোহার খ্যাত কালিকাপ্রসাদ। আর শোনা যাবে না মন ছুঁয়ে যাওয়া মাটির গান। লোকসঙ্গীতের এই নিষ্ঠাবান গবেষকের সুরের সফর থামিয়ে দিল এক ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনা।


মঙ্গলবার দোহারের সঙ্গীদের নিয়ে সিউড়িতে অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছিলেন কালিকাপ্রসাদ। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি,  হুগলির গুড়াপের কাছে, রাস্তার ধারের লোহার ফেন্সিংয়ে ধাক্কা মেরে প্রায় ১৫ ফুট নীচে জলাশয়ে উল্টে পড়ে গাড়িটি।


দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ওপর গুড়াপের মালঞ্চ এলাকায় একটি কালভার্ট রয়েছে। তার আগে রাস্তার ধার বরাবর রয়েছে লোহার ফেন্সিং।


প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি,  কালভার্টে ওঠার আগেই গাড়িটি হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার একেবারে বাঁদিকে চলে যায়। লোহার ফেন্সিংয়ে ঘষা খেতে খেতে সামনের দিকে এগিয়ে, কালভার্টে ওঠার ঠিক মুখে কংক্রিটের কাঠামোতে সজোরে ধাক্কা মারে গাড়িটি। তারপর ফেন্সিং টপকে গড়িয়ে যায় নীচে।


কালভার্টের প্রায় ১৫ ফুট নীচে একটি জলাশয় রয়েছে। সেখানেই উল্টে পড়ে গাড়িটি।জল-কাদার নীচে চলে যায় গাড়ির প্রায় অর্ধেক অংশ।গাড়ির দরজা ভেঙে উদ্ধার করা হয় কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য এবং তাঁর সঙ্গীদের। পাঠানো হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে কালিকাপ্রসাদকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।


তাঁর সঙ্গীরা এখনও চিকিৎসাধীন। গুড়াপে উদ্ধারকাজ চলাকালীন সেখানে যান হুগলির পুলিশ সুপার।


উদ্ধারের পর দেখা যায়, গাড়ির সামনের ডানদিকের চাকাটি নেই। চাকা খুলেই বিপত্তি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান।যা দেখে দুর্ঘটনার দু’টি সম্ভাব্য কারণ উঠে আসছে।


এক কালভার্টে ওঠার মুখে টায়ার ফেটে চাকাটি গাড়ি থেকে খুলে যায়। আর তার জেরেই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারায়।


সম্ভাবনা ২, টায়ার ফেটে যাওয়ার ফলে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লোহার ফেন্সিং ও কালভার্টে সজোরে ধাক্কা মারে। আর তার জেরেই চাকাটি গাড়ি থেকে খুলে যায়।


তবে গাড়িটি যে কতটা জোরে লোহার ফেন্সিং এবং কালভার্টে ধাক্কা মেরেছে, তা গাড়ির অবস্থা থেকেই স্পষ্ট।কালিকাপ্রসাদ সম্ভবত ছিলেন গাড়ির মাঝের বা পিছনের আসনে। গাড়ির সেই অংশও দুর্ঘটনায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই সন্তোষপুরে তাঁর পাড়ায় শোকের ছায়া। প্রতিদিনের অভ্যেসমতো এদিনও বাড়ি থেকে বেরনোর সময় তিনি মেয়েকে বলে গিয়েছিলেন মা আসছি। কিন্তু, আসা আর হল না।


শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ট্যুইট করেন, কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যর অকাল প্রয়াণে আমি মর্মাহত। তাঁর চলে যাওয়া বাংলা সঙ্গীত জগতের পক্ষে অপূরণীয় ক্ষতি। কালিকাপ্রসাদের মৃত্যু আমার ব্যক্তিগত ক্ষতিও বটে। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁর পরিবার ও অনুরাগীদের সমবেদনা জানাই।







কালীকাপ্রসাদের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ সঙ্গীতজগত্। শিল্পীর বাড়িতে পৌঁছে যান মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন। সঙ্গীতজগতের অপূরণীয় ক্ষতি বললেন সুরজিত্।  অভাবনীয় ঘটনা, বললেন শ্রাবণী সেন, গভীরভাবে শোকাহত, মন্তব্য ঊষা উত্থপের।


দুপুরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিল্পীর দেহ প্রথমে আনা হয় নবান্নর সামনে, দ্বিতীয় হুগলি সেতুর টোল প্লাজার কাছে। দুপুর তিনটে নাগাদ সেখানেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি পুলিশকর্তাদেরও নির্দেশ দেন দেহ নিয়ে যেতে কোনও অসুবিধা না হয়।


সেখান থেকে কালিকাপ্রসাদের দেহ পৌঁছোয় সন্তোষপুরের ফ্ল্যাটে। সেখানে তখন উপচে পড়া ভিড়। দাদাকে শেষ দেখা দেখতে এসে কান্না চাপতে পারলেন না কেউই। এরপর বিকেল চারটে নাগাদ দেহ নিয়ে যাওয়া হয় রবীন্দ্রসদনে। কাছের মানুষ কালিকাকে শ্রদ্ধা জানাতে সেখানেও বাঁধভাঙা ভিড়। সন্ধেয় রবীন্দ্রসদনে যান মুখ্যমন্ত্রীও।


কেওড়াতলা মহাশ্মশানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। শেষযাত্রায় শিল্পী-বিদ্বজ্জন এবং অগণিত গুণমুগ্ধর সঙ্গে পা মেলালেন মুখ্যমন্ত্রীও।