প্রশ্ন এখন খুব পরিষ্কার। তৃণমূল থেকে বেরিয়ে যখন বেশ নামকরা নেতানেত্রীরা বিজেপিতে যাচ্ছেন, তার পরিণাম কি হবে? "পরিণাম" শব্দটি যত না বিজ্ঞানসম্মত, তার থেকে বেশি যৌক্তিক শব্দ "অনুসিদ্ধান্ত"। সেই নিরিখে এই মুহূর্তে মূল জিজ্ঞাসা শুভেন্দু অধিকারী মহাশয় তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়ার ফলে সামনের বিধানসভা নির্বাচনে আসন সংখ্যা কি দাঁড়াবে? এর সবথেকে সহজ সমাধান হল জ্যোতিষীর মত কিছু একটা বলে দেওয়া। সেটা বিজ্ঞানসম্মত উপায়েও করা যায়। মুদ্রাক্ষেপণ করে হেড পড়লে বলা হবে তৃণমূল দুশোর ওপর আসন পাবে, টেল পড়লে সেটাই হয়ে যাবে একশোর নিচে। আরও একটি উপায় আছে। খুব গম্ভীর মুখ করে বলা যে "মনে হচ্ছে তৃণমূলই দুশোর ওপর আসন পাবে। তবে নির্বাচনের তো এখনও অনেক দেরি। তাই এর মধ্যে গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিজেপি যদি আরও এক শতাংশ ভোট বাড়াতে পারে তখন কিন্তু আসনের হিসেব ওলটপালট হতে পারে।" অর্থাৎ সহজ কথা হল আগামীর নির্বাচন সম্পর্কে কিছু একটা বলে দিলেই হল। তার পেছনে যুক্তি না থাকলেও ক্ষতি নেই, কারণ এর সৎ রাশিবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে এতো বেশি চলরাশির আবির্ভাব হবে যে তা সমাধান করা প্রায় অসম্ভব। আর সেই সমাধানেও অসম্পূর্ণতা এবং অনিশ্চয়তা থাকবে। তাই যেকোন ভোটসমীক্ষা কিংবা ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কে একটা কথা বুঝে নিতে হবে যে এর পেছনে আছে একাধিক অ্যাসাম্পশন। সেগুলো সঠিকভাবে প্রকাশ করে তারপর অনুসিদ্ধান্তে এলে তবেই সেই আলোচনা যুক্তিগ্রাহ্য। তা না হলে বিনোদনী মূল্যমানেই খুশি থাকতে হবে।


এর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন অ্যাসাম্পশন হল সামনের ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিভিন্ন দলের ভোট শতাংশ ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আশেপাশেই থাকবে। এমনটা না-ই হতে পারে, কিন্তু আলোচনার শুরুতে এটাই স্বতঃসিদ্ধ। এটাই চরম সত্য, অন্তত এই অনুচ্ছেদটির জন্যে। এবার অঙ্কের ভাষায় লিখতে হবে ভোট শতাংশ আশেপাশে থাকা মানে কি। নিয়ম বাঁধা যাক, এক এক দলের ভোট শতাংশ বদলাতে পারে সবথেকে বেশি তিন শতাংশ। যেমন বিজেপি ছিল চল্লিশ মত, তা বাড়াকমা করতে পারে সাঁইত্রিশ থেকে তেতাল্লিশ। তৃণমূল ছিল তেতাল্লিশ, হতে পারে চল্লিশ থেকে ছেচল্লিশ। বাম কংগ্রেস যোগ করে ছিল বারো মত। তৃতীয় জোটে প্রত্যেকের তিন করে বাড়ালেও সেই বারো বড়জোর আঠারোয় পৌঁছবে। ভোট শতাংশ থেকে আসনের হিসেব আরও গোলমেলে। কারণ এই সম্পর্ক অসরলরৈখিক এবং এখানে কোন ভোট শতাংশের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের গল্প নেই। ফলে মোট আঠারো শতাংশ ভোট জুটলে দুশো চুরানব্বইয়ের মধ্যে তিরিশটা আসন পাওয়াও ভীষণ শক্ত। সেই হিসেবে এটা পরিষ্কার যে বাম কংগ্রেস জোট অন্তর্নিহিত অ্যাসাম্পশনের ভিত্তিতে কোনভাবেই ক্ষমতায় আসবে না। হাতে রইল তৃণমূল এবং বিজেপি। এবার এদের মধ্যে ভোট বাড়াকমা হলে আসন সংখ্যা বদলাবে। এখানে বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। তার মধ্যে একটি পথ খুঁজে দেখা যাক। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের ভোট বিন্যাসকে বিধানসভা আসনের ভিত্তিতে দেখলে তৃণমূল ১৬৪, বিজেপি ১২১, আর কংগ্রেস ৯। সেখান থেকে দুই শতাংশ ভোট তৃণমূল থেকে বিজেপির দিকে ঘুরে গেলেই বিজেপির আসন সংখ্যা ১৫০ পেরিয়ে যাবে। এই অনুচ্ছেদে যে গোটা ঘটনাটা লেখা হল এরকম অসংখ্য সম্ভাবনা থাকতে পারে। তার মধ্যে অনেকগুলি বাস্তবসম্মত। তবে আদতে সত্যি যে কি ঘটবে তা আগে থেকে বলা অসম্ভব। প্রচুর অর্থব্যয়ে উন্নত মানের সমীক্ষায় হয়তো ভোটফলের আর একটু বেশি আভাস পাওয়া যাবে। কিন্তু লড়াই কঠিন হলে সেখানেও সমীক্ষার সাফল্য যথেষ্ট অনিশ্চিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষক বা ভোটকুশলীদের জেরা করে যা জানা যাবে, সাধারণ মানুষও সেই একই কথা বলবেন। আর যদি বলেন লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভা তুলনা করা ভুল, তাহলে এই অনুচ্ছেদটি মুছে দিলেই হল।

এবার আসা যাক রাজনৈতিক নেতাদের কথায়। ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর বলেছেন বিজেপি একশোর নিচে থাকবে। অন্যদিকে তার আগেই বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় ঘোষণা করেছেন বিজেপি জিতবে দুশোর বেশি আসন। গত ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনেও বাম কংগ্রেস জোট দুশোর বেশি আসন জিতবে বলেছিল। গত লোকসভায় তৃণমুল বলেছিল বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ। অর্থাৎ রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতানেত্রীদের আসন সংক্রান্ত বিশ্লেষণ পুরোটাই নির্বাচনী প্রচার, যেখানে সবসময় জিতব বলতে হয়। তবে নেতাদের আসনের সংখ্যা বলার মধ্যেও একটা ক্ষুদ্রতম, মধ্যমান, এবং বৃহত্তম খুঁজে নিতে হয়। কৈলাসবাবু যখন বলেন বিজেপি দুশোর বেশি আসন পাবে, তখন অঙ্কের নিয়মে সেটা ন্যুনতম হলেও, রাজনৈতিক বিশ্লেষণে তাকে মধ্যমান ধরে নেওয়াই ভালো। অর্থাৎ বিজেপি বলছে যে তৃণমূল একশোর নিচে আসনে জিতবে। উল্টোদিকে প্রশান্ত কিশোরের বক্তব্য বিজেপি জিতবে একশোর কম আসন। এর থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে বিজেপি বা তৃণমূল নিজেদের সুবিধে মত পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪ আসনকে দুইয়ের-তিন বনাম একের-তিন এ ভাগ করছে। এটা বিপক্ষকে যথেষ্ট সম্মান দেওয়ার সামিল। অর্থাৎ দুদলই মনে করছে যে শতাংশের নিরিখে তারা বেশ কাছাকাছি থাকবে। কোন না কোন ফুল ফুটবে বঙ্গ-গোবরে। সাধারণ হিসেব বলে মেরুকরণের রাজনীতিতে মূল দুই বিরোধী দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলে দুজনেই চল্লিশ শতাংশের ওপর ভোট পাবে। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য শুনে সেটাই মনে হচ্ছে। আবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক, এটা সেই সব নেতার বিশ্বাস। এর পেছনে অঙ্ক থাকা বা না থাকায় খুব কিছু আসে যায় না। এই পারসেপশন যদি জনমনে বজায় থাকে, তাহলে সামনের দিনে সবথেকে মুশকিল তৃতীয় পক্ষের। কারণ উইনেবিলিটি না থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের জন্যে ভোট নষ্ট করবে না, আরও খারাপ হবে তাদের ফলাফল।

এবার আজকের দিনে রাজনৈতিক উপলব্ধির একটা রূপরেখা খোঁজার চেষ্টা করা যাক। এই ভাবনা আসছে গত ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে বাম-কংগ্রেসের পতন এবং বিশেষ করে ২০১৯ লোকসভায় বিজেপির উত্থানকে কেন্দ্র করে। এর সঙ্গে যোগ হবে সাম্প্রতিক সময়ে তৃণমূল থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিজেপিতে যোগদান। দলবদল করা নেতার দাম ভোট সরানোয়। তেমন হলে লড়াই জমবে। সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৫০ আসনে তৃণমূল বিজেপি সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, আর ত্রিমুখী লড়াই বাকি কয়েকটি আসনে। তবে সেগুলোতেও বেশিরভাগ জায়গায় জিতবে তৃণমূল বা বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে দু-দলের ভোট শতাংশ খুব কাছাকাছি হয়ে গেলে (দু শতাংশের মধ্যে) আসনের হিসেবে যে কেউ জিততে পারে। আর কোন একটি দল যদি তিন শতাংশের মত ভোটের ব্যবধান বানিয়ে ফেলতে পারে তাহলে তার আসনের হিসেবে জেতার সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি। উদাহরণ আবার সেই ২০১৯ লোকসভা নির্ভাচনের বিধানসভা-ওয়ারী ফলাফল। তিন শতাংশের মত ভোটে এগিয়ে থেকে তৃণমূল পেয়েছিল ১৬৪ টি আসন। আর জনমত যদি এক দিকে নির্দিষ্ট হয়ে যায়, তখন ভোট শতাংশের ব্যবধান পাঁচ শতাংশের আশেপাশে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে কোন একটি দল দুশোর ওপর আসন পেয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। নেতানেত্রীরা তেমনটাই ভবিষ্যৎবাণী করছেন নিজের নিজের দলের হয়ে। সেখানেই আসছে নিজের দুশোর বেশি আর অন্যের একশোর কমের গল্প।

এবার একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র সম্ভাবনার বিষয় আলোচনা করা যাক। এমনটা ঘটবে না ধরে নেওয়াই ভালো। কারণ নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে যখন তৃণমূল বিজেপি মেরুকরণ সম্পূর্ণ, তখন বাম-কংগ্রেস শীতঘুমে। তবু ভাবা যাক, বামেদের যে ভোট গত কয়েকবছর ধরে বেশি করে বিজেপি আর কম করে তৃণমূলে গেছে, তার কিছুটা ফেরত এলো। সেক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের ভোট বাড়বে। স্বাভাবিকভাবেই তখন তৃতীয় পক্ষের ভোট কাটার ওপর নির্ভর করবে বিজেপি-তৃণমূলের ফলাফল। কংগ্রেস গত লোকসভা নির্বাচনে দুটি আসন জিতেছিল। মুর্শিদাবাদ কিংবা মালদার মত জেলায় ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে তারা আসন জেতার ক্ষমতা রাখে। ফলে ভোট শতাংশে খুব উন্নতি না করলেও কংগ্রেসের আসনের সংখ্যা লোকসভার হিসেবে ৯ এর তুলনায় কিছুটা বাড়তেই পারে। বামেদের ক্ষেত্রে কিন্তু আসনের তুলনায় ভোট শতাংশ বাড়ার সুযোগ বেশি। যারা তৃণমূলের বিরোধিতা করার জন্যে ২০১৯ নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, তারা এখন দেখছেন সেই তৃণমূলের অনেক নেতাই বিজেপির দলে। সেই ক্ষোভে তারা সিপিএমে ফিরতেও পারেন। আর একটি বিষয় মনে রাখতেই হবে। তা হল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল এবং বিজেপির ওপর বিরক্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকছে তাদের সাম্প্রতিক কার্যকলাপে। বিজেপি কেন্দ্রে এবং তৃণমূল রাজ্যে কিছু জনমুখী কাজ তো অবশ্যই করেছে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে শুধুই সামনে উঠে আসছে হিংসা এবং দুর্নীতি সক্রান্ত আলোচনা। বছর শেষের রবিবারে দুই দলের দুই নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারী একে অপরকে তোলাবাজ বলে আক্রমণ করেছেন। মনে রাখতে হবে এদের মধ্যে অন্তত একজন নির্বাচনের পর এই রাজ্যে বড় দায়িত্ব পাবেন। বিধান রায় এবং জ্যোতি বসু একে অপরকে জনসভায় তোলাবাজ বলছেন, এমনটা বোধহয় বাঙালির ঐতিহ্য নয়। এই জায়গাটাই আজকের বাংলায় দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সংকট।

তবে সবশেষে আবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক যে এইসময় জনসাধারণ যতই বিরক্ত হোন না কেন, তারা সকলেই মনে করছেন যে লড়াই তৃণমূল বনাম বিজেপি। বিজেপিকে রুখতে বাকি সব দলের এককাট্টা হওয়ার একটা আজগুবি তত্ত্ব বাজারে ভাসছে। সম্ভবত এই ভাবনা উৎসারিত হচ্ছে অতিবাম দর্শন থেকে। সেক্ষেত্রে মোক্ষম সুবিধে হবে বিজেপিরই। কারণ বাম-কংগ্রেস-তৃণমূলের ওপর বিরক্ত লোকজনের হাতে তখন একটাই বিকল্প থাকবে। সংখ্যাগুরু ভোটের বড় অংশ সেক্ষেত্রে কেন্দ্রের শাসক দলের দিকে ঝুঁকতেই পারে। ফলে তৃণমূল সেই জায়গাটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে বলেই মনে হয়। ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত তৃণমূলের উত্থানের পেছনে অতিবামদের যথেষ্ট অবদান ছিল। কিন্তু এবার মহত্তর এবং বৃহত্তর জোটের অঙ্ক তৃণমূলের কাছে ব্যুমেরাং হয়ে জেতে পারে। অন্যদিকে উজ্জীবিত বামফ্রন্ট বেশি অসুবিধে করবে বিজেপির। কারণ তাদের কাছ থেকে বামেরা ভোট ফেরত পেলে তৃণমূল আবার দুশো পেরিয়ে যাবে। সামনের দিনগুলোতে এই আলোচনা চলতেই থাকবে। বিশ্লেষকরা এই শব্দরাশিতে ভর করে গাদা গাদা লিখবেন, তার পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা হবে। কিন্তু শেষমেশ ভোট দেবেন এই বাংলার আমজনতা। তাঁরাই নির্ধারণ করবেন এই বঙ্গের ভোটফল। সেখানেই গণতন্ত্রের সার্থকতা, যদি নিজের ভোট নিজে দেওয়া যায়।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)