সমিত সেনগুপ্ত, কলকাতা: ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারি মাস। পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট নিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে অরুণাচল প্রদেশ। পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিক্ষোভকারীরা আগুন লাগিয়ে দেয় উপ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে। কারণ ছিল, এই রাজ্যের যারা ভূমিপুত্র, তাঁরা চান না যে তাঁরা ছাড়া অন্য কোনও মানুষ এমনকি, এদেশের অন্য প্রান্তের বাসিন্দারাও অরুণাচলে স্থায়ীভাবে বসবাসের ছাড়পত্র পাক। আমাদের দেশে এই ভূমিপুত্রের ধারনাটা কোনও কোনও অঞ্চলে এখনও পর্যন্ত এতটাই গোঁড়া।


ভূমিপুত্র শব্দের অর্থ ভূমিজ - অর্থাৎ আদিবাসী। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে ভূমিপুত্র শব্দটির প্রচলন এখন যথেষ্ট লক্ষণীয়। ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে এই শব্দটির প্রয়োগ প্রথম করেন বিজেপি নেতা তথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বোলপুরে সাংবাদিক বৈঠকে অমিত শাহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে বাংলার কোন ভূমিপুত্রই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন। কিন্তু কেন হঠাৎ ভূমিপুত্র প্রসঙ্গ? কারণ ইতিমধ্যেই রাজ্যের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল, তাদের মূল প্রতিপক্ষ বিজেপি দলের নেতাদের বহিরাগত বলে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচার কৌশল অবলম্বন করেছে। আর এই বহিরাগত তত্ত্বকে খারিজ করতে বিজেপির তরফে এই ভূমিপুত্র ধারণাকে সামনে তুলে ধরে পাল্টা প্রচার চলছে। বিজেপির তরফে বোঝানোর চেষ্টা চলছে, এটি একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল হলেও, বিজেপি এরাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে এই রাজ্যেরই কোন একজন মুখ্যমন্ত্রী হবেন। যদিও এই বিষয়টি কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে আলাদা করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তার কারণ যে রাজ্যের ভোট, সাধারণত সেই রাজ্যের বাসিন্দা কোনো এক বিধায়কই সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে থাকেন। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস বাংলা ও বাঙালি আবেগকে হাতিয়ার করে ভোট প্রচারের ময়দানে যে ভাবে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে, সেই প্রচার কৌশলকে টেক্কা দিতে বিজেপির তরফে ভূমিপুত্র মুখ্যমন্ত্রীর ধারণা নির্বাচনী উত্তেজনার পারদ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে - যার পাল্টা তৃণমূলের ' বাংলা নিজের মেয়েকেই চায় '।


রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের সবচেয়ে হাই ভোল্টেজ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে চলেছে নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর তার বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির বাজি একসময়কার মমতার সতীর্থ শুভেন্দু অধিকারী। প্রার্থী তালিকায় শুভেন্দুর নাম ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চর্চা শুরু হয়ে যায় তাহলে কি শুভেন্দু অধিকারী কে ইঙ্গিত করেই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের এই ভূমিপুত্র ধারণা সামনে তুলে ধরা? শুভেন্দু অধিকারী কি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদের মুখ? আবার গত ৭ মার্চ নরেন্দ্র মোদির ব্রিগেড সমাবেশ অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর বিজেপিতে আবির্ভাবের পর আলোচনা শুরু হয়ে যায়, তাহলে কি উত্তর কলকাতার ছেলে, একসময়কার বলিউডের প্রথম সারির অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী-ই কি সেই ভূমিপুত্র? যদিও বিজেপির তরফে জানানো হয়েছে যে মিঠুন চক্রবর্তী ভোটে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক নন।


তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন রবিবারের পর থেকে বিষয়টা যেন আরও কিছুটা জটিল হয়ে গেল। বিজেপির দিল্লি সদর দফতর থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের জন্য যে আসনগুলিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে তারমধ্যে ৪ জন সাংসদ-কে প্রার্থী করা হয়েছে। আসানসোলের সংসদ বাবুল সুপ্রিয়, হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়, কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ প্রামানিক ও রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত। তিনজন লোকসভার সাংসদ রাজ্য রাজনীতি মানচিত্রে ডাকাবুকো হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। সূত্রের খবর শান্ত স্বভাবের স্বপন দাশগুপ্তর উচ্চশিক্ষিত হওয়ার কারণে বাঙালি মনকে প্রভাবিত করা সম্ভব বলে মনে করেন বিজেপি নেতৃত্ব। দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ' পাওয়া স্বপন দাশগুপ্ত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এর উপর গবেষণা করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবেও কর্মজীবনের বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছেন। কখন আবার পারিবারিক ফার্মাসিটিক্যালস ব্যবসা সামলেছেন, আবার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে স্বপনবাবুর। তারকেশ্বর কেন্দ্র থেকে ভোটে লড়বেন বিজেপির এই বর্ষীয়ান নেতা। 


আবার হুগলি আসনে পদ্মফুল ফুটিয়ে এবং লোকসভায় বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার হয়ে লকেট চট্টোপাধ্যায়ও এখন যথেষ্ট লাইম লাইটে আছেন। এবার টার্গেট চুঁচুড়া। টালিগঞ্জের প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় ২০১৬ বিজেপিতে যোগদান করে। সেই বছরই বীরভূমের ময়ূরেশ্বর কেন্দ্র থেকে বিধানসভা নির্বাচনের প্রার্থী হন। কিন্তু জিততে পারেননি লকেট। কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকের ওপরেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বে ভরসার কথা বিজেপি তে কারোর অজানা নেই। উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ অঞ্চলে রাজবংশী ভোটারদের আধিপত্য। আর সেই প্রভাবশালী রাজবংশী প্রতিনিধি কে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে বার্তা দিতে চাইছে বিজেপি নেতৃত্ব। একদা তৃণমুলের যুব নেতা বর্তমানে উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ প্রামানিক ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে জিতে তৃণমূলের দুর্গেই ভাঙ্গন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এবারে নিশীথের কাছে চ্যালেঞ্জ দিনহাটা আসন।


তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণা, ভূমিপূত্র তত্বে সবচেয়ে বড় চমক বাবুল সুপ্রিয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার দরুন প্রশাসনিক কাজে দক্ষতা অনেকাংশেই বাবুলের পক্ষে যাবে বলে মত। প্রথমে ডন বস্কো এবং পরে শ্রীরামপুর কলেজ থেকে পড়াশোনা করে একটি বহুজাতিক ব্যাংকে চাকরি। সেই চাকরি ছেড়ে মুম্বইতে পাড়ি দেওয়া প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে। টিনসেল টাউনে যশ এবং প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর, ২০১৪-এ রাজনীতিতে হাতে খড়ি লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী হয়ে। প্রথম বারেই বাজিমাত। নির্বাচনে জিতে ৬ মাসের মধ্যে জায়গা পেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়। ২০১৯-এ জয়ের মার্জিন প্রায় তিন গুণ বাড়িয়ে পুনরায় মোদি মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নেন মধ্যবয়সি বাবুল। এখনো পর্যন্ত তিন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন বাবুল। হুগলির উত্তরপাড়ার ছেলে - গায়কীর জন্য দেশ জোড়া খ্যাতি। বিদেশেও সমান জনপ্রিয়। দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে কান পাতলেই শোনা যায় বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব তো বটেই - স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাবুলের কাজের জন্য তাকে পছন্দ করেন। প্রধানমন্ত্রীকে বলে কার্যত বিশবাঁও জলে পড়ে থাকা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের কাজ নিজে হাতে তুলে নেওয়ায় নাকি নরেন্দ্র মোদি বাবুলের ওপর যথেষ্ট খুশি হয়েছিলেন। তাহলে কি বাবুলই ভূমিপুত্র ধারনার বাস্তব রূপ? 


যদিও বিজেপির তরফে এবিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাওয়া হয়নি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এখনও পর্যন্ত যে যে নামগুলি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদের মুখ হিসেবে উঠে এসেছে তার মধ্যে বাবুল সুপ্রিয়র পাল্লা সবচেয়ে ভারী। একাধারে দু’বারের সংসদ, তিনটি মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার অভিজ্ঞতা, একাধিক গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রী গোষ্ঠীর সদস্য হওয়া, বাঙালি গায়কের দেশ জোড়া খ্যাতি- সবটাই বিজেপি নেতৃত্বের রাডারে আছে বলে খবর। তবে ২ মে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর এই চিত্রটা পরিষ্কার হবে।