কৃষ্ণেন্দু অধিকারী, আবীর দত্ত ও আশাবুল হোসেন: প্রচারে গিয়ে নন্দীগ্রামে আহত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার সন্ধেয় হরিনাম সংকীর্তনের একটি অনুষ্ঠান থেকে নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়ায় নিজের অস্থায়ী ঠিকানায় ফিরছিলেন তিনি। 


মাঝপথে বিরুলিয়া বাজারের কাছে লোকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামান মমতা। হাত নাড়তে শুরু করেন। অভিযোগ, আচমকাই ৪-৫জন এসে তাঁকে ধাক্কা দেন। মাথায়, কপালে এবং পায়ে চোট লাগে। বাজারে দাঁড়িয়ে একটি দোকান থেকে বরফ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে লাগানো হয়। এরপর নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়ায় নিজের অস্থায়ী ঠিকানার উদ্দেশে রওনা দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়। 


স্থানীয় একজন চিকিৎ‍সকে ডাকা হয়। ফের বরফ ঘষা হয় মুখ্যমন্ত্রী পায়ে।  তারপরও ব্যাথা বাড়তে থাকায় তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। পরিকল্পনামাফিক গোটা ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ তৃণমূল নেত্রীর। বললেন, এটা অবশ্যই চক্রান্ত। ইচ্ছাকৃতভাবে মারা হয়। ঘটনাস্থলে রাজ্য পুলিশের কেউ ছিল না বলেও জানান তিনি।


মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগ নিয়েই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, "তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিরকাল মানুষের সঙ্গে মেশেন। সেই সুযোগ নিয়ে তাঁকে এইভাবে ধাক্কা মারা হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে। ভালরকম চোট পেয়েছেন তিনি। স্থানীয় পুলিশের যে যে ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল সেগুলি সেভাবে নজরে পড়েনি। ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং ইঙ্গিতবাহী। গোটা ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। তাঁর যথাযথ নিরাপত্তার দাবি জানাচ্ছি। যাঁরা নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে ভীত এবং উদ্বিগ্ন তারাই এই ধরনের উদ্বেগজনক, ভারসাম্যহীন, অপরিণত ঘটনা ঘটিয়েছে।" 


রাজ্য বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "মুখ্যমন্ত্রীর দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নির্বাচনী প্রচারে ফিরে আসুন। আমি চাই তাঁর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন তাঁর সহযোগীরা। মুখ্য়মন্ত্রীর আঘাতে আমরা ব্য়থিত। তবে মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ অত্য়ন্ত গুরুতর। এর জন্য অবিলম্বে তদন্তের প্রয়োজন আছে। এর পিছনে ষড়যন্ত্র আছে কি না তা দেখার জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের প্রয়োজন রয়েছেন। রাজ্যবাসী উদগ্রীব। আমরাও দলের পক্ষ থেকে সেটা জানতে চাই। তদন্ত হওয়া প্রয়োজন আছে। জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পাওয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কেন সেইসময় পুলিশ ফোর্স ছিল না, কেন উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ আধিকারিক উপস্থিত ছিলেন না সেটা জানার জন্য তদন্তের প্রয়োজন আছে।"


পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, "আঘাত গুরুতর, সাংঘাতিক। চিকিৎসকরা দেখলেই বুঝতে পারবেন। দেখে যা মনে হচ্ছে উনি যাতে নির্বাচনের কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে না পারেন তার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র করে ওঁনার উপর হামলা করা হয়েছে। পরিকল্পনা মাফিক করা হয়েছে হামলা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক সময় আবেগ প্রণোদিত হয়ে নিরপত্তার থেকে অনেক দূরে সরে যান। নিজের মতো নিজেকে রাখেন। 


বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংহ ঘটনাকে মুখ্যমন্ত্রীর নাটক বলে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, "ওঁনাকে কে হামলা করবে? তার মানে উনি পুলিশমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর যোগ্য নন। এখনও কেয়ারটেকার আছেন। ওঁনার রিজাইন দেওয়া উচিৎ। ওঁনার সঙ্গে যে যে আইপিএস অফিসার ছিলেন সবাইকে সাসপেন্ড করা উচিত। কেউ যদি মেরে থাকে তাকে ফাঁসি দেওয়া উচিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে যান তার দুই কিলোমিটার আগে থেকে রাস্তা ফাঁকা করে দেওয়া হয়। ওঁনার উপর হামলা হবে? এটা মিথ্যে কথা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মিথ্যা কথা বলেন। সমবেদনা নেওয়ার চেষ্টা করেন। এবারও তাই করছেন। উনি হারবেন তা নিজে জানেন। সেই জন্য এই নাটক করছেন।"


পরিষদীয় প্রতিমন্ত্রী তাপস রায় বলেন, "এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। বঙ্গবাসী দুশ্চিন্তায় রয়েছে। এর আগেও তাঁর উপর অনেক হামলা হয়েছে। আমরা আগেও দেখেছি নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রিয় নেতা-নেত্রী খুন হয়েছেন। খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। যাঁরা কদর্থ করছেন তাঁরা নিজের আয়নায় অন্যকে দেখার চেষ্টা করছে।"


মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগকে বিশ্বাস করতে রাজি নন অধীর চৌধুরী। গোটা বিষয়টিকে 'ভন্ডামি' বলে কটাক্ষও করেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। তিনি বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের পুলিশমন্ত্রী যদি বলেন পুলিশ ছিলেন না তাহলে দুর্ভাগ্যের কথা। কারণ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তিনি তো পুলিশমন্ত্রীও বটে। পুলিশের মালিক তিনি। তাঁর উপর যখন হামলা হল ঠিক তখনই পুলিশ নেই। হামলাতে শুধুমাত্র তাঁর পায়েতেই লাগল। নন্দীগ্রামেই হল। সেখানে ভোটের প্রচারের জন্য আবেগ, সেন্টিমেন্ট তৈরি করতে হবে। মেয়েদের উপর হামলা হচ্ছে প্রমাণ করতে হবে। এগুলি নির্বাচনের এক একটা অঙ্গ বলে আমি মনে করি। এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থাৎ বাংলার দিদি আর দেশের মোদি নাটক করতে একে অপরের পরিপূরক। তাই এইসব ভন্ডামিতে আমি বিশ্বাস করি না। এটা বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ভন্ডামি। রাজনৈতিকভাবে সেন্টিমেট তৈরি করতে চাইছেন।"


বিজেপি সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেন, "উনি যখন পদযাত্রা করেন বা স্কুটি চালান তখন ওঁনার সঙ্গে বহু পুলিশকর্মী থাকেন। তারপরেও তাঁর উপর এই হামলা হতে পারে কি? বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে আমার মনে হচ্ছে। ওঁনার প্রতি আমার সহানুভূতি রয়েছে। তবে হামলা হয়েছে বলে লোকের কাছ থেকে সহানুভূতি নেওয়া ঠিক না।" 


অন্যদিকে, নন্দীগ্রামের সিপিএম প্রার্থী মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায় বলেন, "তাঁর চোট পাওয়া দুর্ভাগ্যজনক। দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। ভাল থাকুন। ১০ বছর ধরে ওঁনার এই চক্রান্তের অভিযোগ শুনেছি। পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ প্রশাসন নেই। যাঁরা বলছেন নাটক তাঁরা বেশি ভাল বলতে পারবেন এটা নাটক না কি সত্যি। তাঁরা এতদিন ওঁনার নাটকের সঙ্গে থাকতেন।"


এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে তীব্র চাপানউতোর শুরু হয়েছে। হাওড়া, জলপাইগুড়ি, বাঁকুড়া-সহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল। ভোটের উত্তাপে আগে থেকেই ফুটছিল নন্দীগ্রাম। এক লাফে তা আরও বেড়ে গেল।