নয়াদিল্লি: ভারতের নাগরিকত্বের প্রশ্নে অসম চুক্তির বৈধতা বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট। অর্থা ১৯৭১ সালের আগে অসমে প্রবেশকারী বাংলাদেশি শরণার্থীরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবেই বিবেচিত হবেন। ১৯৮৫ সালে ভারতে প্রবেশকারী বাংলাদেশি শরণার্থীদের (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) জন্য নাগরিকত্ব আইনে ৬এ অনুচ্ছেদটি সংযুক্ত করা হয়। ওই আইনের আওতায় ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির পর থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পর্যন্ত অসমে প্রবেশকারী বাংলাদেশি শরণার্থীদের রাজ্যের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে সামনে রেখে ওই আইনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আদালতে আবেদন জমা পড়েছিল। কিন্তু শীর্ষ আদালত ওই আইনের বৈধতা বহাল রাখল। (Supreme Court)


৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুচ্ছেদ ৬এ-র বৈধতায় সায় দিয়েছে শীর্ষ আদালত। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। বিচারপতি সূর্যকান্ত, বিচারপতি এমএম সুরেশ এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র অসম চুক্তির বৈধতার পক্ষে রায় দেন। একমাত্র বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এর বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত আদালত বলে, "আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পর্যন্ত যাঁরা বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন, তাঁরা ভারতের নাগরিক হওয়ার যোগ্য। ওই আইনের আওতায় যাঁরা নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন, তাঁদের নাগরিকত্ব বহাল থাকবে।" (Assam Accord)


অসম চুক্তির বিরোধিতা করে যাওরা আদালতে গিয়েছিলেন, তাঁদের দাবি ছিল, দলে দলে বাংলাদেশি শরণার্থীদের আগমনের ফলে অসমের জনসংখ্যার ভারসাম্যে প্রভাব পড়েছে। অনুচ্ছেদ ৬এ অসমের প্রকৃত বাসিন্দাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে বলেও দাবি করা হয়। কিন্তু প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের মতে, বাংলাদেশি শরণার্থীদের আগমনের ফলে যে অতুলনীয় সমস্যা দেখা দেয়, তার 'রাজনৈতিক সমাধান' হয়ে ওঠে অনুচ্ছেদ ৬এ। প্রধান বিচারপতির বক্তব্য, "কেন্দ্রীয় সরকার অন্যত্রও ওই আইন চালু করতে পারত, কিন্তু তা করা হয়নি কারণ অসমেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছিল। অসমে আগত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৪০ লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশকারী শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৭ লক্ষ। কিন্তু অসম আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে ছোট। তাই অসমের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়।"


মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের ভিড় নিয়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। সেই নিয়ে ১৯৮৫ সালের ১৫ অগাস্ট কেন্দ্রীয় সরকার এবং অসম আন্দোলনের প্রতিনিধি All Assam Students' Union (AASU)-র মধ্যে অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মানবিকতার খাতিরে নাগরিকত্ব আইনে ৬এ অনুচ্ছেদটি যুক্ত করা হয়, যার আওতায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। তবে ভোটাধিকার দেওয়া হয়নি। অনিয়ন্ত্রিত ভাবে শরণার্থীরা অসমে প্রবেশ করলে রাজ্যের জনবিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে যে যুক্ত দেয় কেন্দ্র, বেআইনি অনুপ্রবেশ রোখার পক্ষে কেন্দ্রের যে যুক্তি, তা ঠিক বলেও এদিন মেনে নেয় আদালত। তবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে যাঁরা ভারতে এসেছিলেন, তাঁদের দেশের নাগরিক বলেই গন্য করে আদালত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যাঁরা ভারতে প্রবেশ করেন, তাঁরা নাগরিক নন বলে জানান বিচারপতি সূর্যকান্ত। পাশাপাশি, অসম চুক্তির পরও বেআইনি অনুপ্রবেশ রুখতে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ করা হয়নি বলেও মেনে নেয় আদালত। বলা হয়েছে, ফরেনার ট্রাইবুনালসে ৯৭ হাজার ৭১৪টি মামলা পড়ে রয়েছে। এখনও ৮৫০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া বসেনি, নজরদারিতেও ফাঁক রয়েছে। বেআইনি অনুপ্রবেশ নিয়ে কী পদক্ষেপ করা হচ্ছে সেদিকে নজর থাকবে আদালতের।


বিচারপতি কান্ত আরও জানান, 



  • ১৯৬৬ সালের আগে অসমে প্রবেশকারী শরণার্থীরা এদেশের নাগরিক।

  • ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিলের আগে যাঁরা প্রবেশ করেছেন, তাঁরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন, অনুচ্ছেদ ৬এ অনুযায়ী। 

  • ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যে সমস্ত শরণার্থী অসমে প্রবেশ করেন, তাঁরা অনুচ্ছেদ ৬এ-র আওতায় সংরক্ষণ পাবেন না। তাঁরা বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গন্য হবেন।


অনুচ্ছেদ ৬এ-এর আওতায় ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে মাপকাঠি নির্ধারণ করে তদানীন্তন রাজীব গাঁধী সরকার। ২৬ মার্চ যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, সেই কারণে ওই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়। যদিও মামলাকারীদের দাবি ছিল, ২৫৩ ধারায় ওই আইনকে বৈধতা দিতে যেহেতু কোনও পদক্ষেপ করেনি কেন্দ্র, তাই অসম চুক্তির বৈধতা নেই। কিন্তু প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় সাফ জানিয়েছেন, যুক্তিসম্মত ভাবেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিনটিকে মাপকাঠি ধরা হয়। কারণ ওই দিনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছিল। আদালত আরও জানিয়েছে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষজনের উপস্থিতিতে অনুচ্ছেদ ২৯ (১) লঙ্ঘিত হয় না, যার আওতায় নিজস্ব ভাষা, লিপি বা সংস্কৃতি সংরক্ষণের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। এ নিয়ে আদালতে কেন্দ্রীয় সরকার যে হলফনামা জমা দেয়, তাতে বলা হয়েছিল, ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত অসমে প্রবেশকারী ১৭ হাজার ৮৬১ জন শরণার্থী ভারতের নাগরিকত্ব পান। 


জাতীয় নাগরিক পঞ্জি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা ক্ষেত্রে অসম চুক্তির ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। CAA-র মাধ্যমে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার পড়শি দেশের অমুসলিম শরণার্থীদের নাগপরিকত্ব দেওয়ার বিধান আনলেও, ২০১৪ সালের ভোটার তালকার নিরিখে তৈরি অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ে ১৯ লক্ষের, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই অমুসলিম। NRC এড়িয়ে কোনও ভাবে CAA-র মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে না বলে ঘোষণা করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। 


সেই নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যেই অসম চুক্তির বৈধতায় সায় দিল আদালত, যাকে 'ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত' বলে উল্লেখ করেছেন বিরোধীরা। অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (AIUDF) কেক কেটে আদালতের রায় উদযাপন করেছে। দলের বিধায়ক আমিনুল ইসলাম বলেন, "এই সিদ্ধান্তে অসমের জয় হয়েছে। আশা করি, আর রাজনৈতিক জলঘোলা হবে না।" এই সিদ্ধান্তের পর জাতীয় নাগরিক পঞ্জি এবং ভোটার চিহ্নিকরণের প্রক্রিয়া আরও মসৃণ হবে বলেও আশাবাদী তিনি। রায়জোর দলের নেতা অখিল গগৈরের মতে, এর পর অসমে আর CAA কার্যকর হয় না। অসম প্রদেশ কংগ্রেসের প্রধান ভূপেন বরার দাবি, নিজের রাজনৈতক স্বার্থ চরিতার্থ করতে অসম চুক্তিকে খাটো করার চেষ্টা করছিলেন হিমন্ত। আদালতের রায়ে অসমের মানুষের জয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ রিপুন বরা আদালতের রায়কে 'ঐতিহাসিক' বলে উল্লেখ করেন। তাঁর বক্তব্য, "১৯৮৫ সালের ১৫ অগাস্ট রাজীব গাঁধির নেতৃ্ত্বে অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার আওতায় নাগরিকত্বের জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিনটিকে মাপকাঠি ধরা হয়। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে অসমের সকল মানুষ সেটি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বিজেপি সরকার, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত মানুষকে বিভ্রান্ত করছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল, বেআইনি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণে ১৯৭১ সালর ২৫ মার্চ দিনটিই মাপকাঠি।"