নয়াদিল্লি: সীমান্ত সংঘাত পুরোদস্তুর যুদ্ধের আকার নিচ্ছে ক্রমশ। এশিয়ার দুই দেশ, তাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়া এই মুহূর্তে সম্মুখ সমরে। সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে রকেট বর্ষণ পর্যন্ত শুরু হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। তাইল্যান্ডকে লক্ষ্য করে কামান দাগার পাশাপাশি, রকেট ছোড়ে কম্বোডিয়া। এর পাল্টা, বৃহস্পতিবার কম্বোডিয়ার সেনা শিবির লক্ষ্য় করে আকাশপথে হামলা চালায় তাইল্যান্ড। সেখানে এয়ারস্ট্রাইক চালায় তারা। হতাহতের খবরও উঠে আসছে সেখান থেকে। (Thailand-Cambodia Border Dispute)
কম্বোডিয়ার ছোড়া রকেট তাইল্যান্ডের সিসাকেতের একটি পেট্রোল পাম্পে আছড়ে পড়ে বলে জানা যাচ্ছে,তাতে ছ'জন নিরীহ নাগরিক মারা গিয়েছেন। CNN জানিয়েছে, একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ভিতর থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখা গিয়েছে। রাস্তায় পড়ে কাতরাতে দেখা যায় একজনকে। বহু মানুষ আহতও হয়েছেন। সুরিন প্রদেশ থেকে দু'জনের মৃত্যুর খবর মিলছে। উবন রতচাথানিতে একজন মারা গিয়েছেন। (Thailand-Cambodia Air Strike)
তাইল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে, কম্বোডিয়ার সঙ্গে সংঘাতে দেশের ১২ জন নিরীহ নাগরিক মারা গিয়েছেন এখনও পর্যন্ত। তাইল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোমসাক থেপসুতিন জানিয়েছেন, হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে কম্বোডিয়া, যা যুদ্ধাপরাধের সমান। কম্বোডিয়াকে এর দায় নিতে হবে। তাইল্যান্ডের বিদেশমন্ত্রকের দাবি, বৃহস্পতিবার সকালে প্রথমে কম্বোডিয়ার সেনা প্রচুর গোলাগুলি বর্ষণ করে। তাইল্যান্ডের সেনার শিবির লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। বসতি এলাকা, এমনকি হাসপাতালেও আঘাত হানে তারা, তার জেরেই প্রাণহানি ঘটেছে।
অন্য দিকে, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত সরাসরি রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। তাইল্যান্ডের আগ্রাসন ঠেকাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক প্রয়োজন বলে মত তাঁর। হুনের দাবি, সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায়, পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কম্বোডিয়ার উপর হামলা চালিয়েছে তাইল্যান্ড। সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে কম্বোডিয়ার সেনা শিবিরগুলিকে নিশানা করা হয়েছে। তাইল্যান্ড আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে বলে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট আসিম ইফতিকার আহমেদকে চিঠি লিখেছেন তিনি।
সীমান্ত নিয়ে তাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ার মধ্যে বরাবরই সংঘাত। দুই দেশের মধ্যে ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থলসীমান্ত রয়েছে। কম্বোডিয়া যখন ফরাসি উপনিবেশ ছিল, সেই সময় ফরাসিরাই মূলত ওই সীমান্তরেখা টানে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের পতনের পর থেকে গত কয়েক দশকে বার বার সীমান্ত নিয়ে রক্তপাত ঘটেছে তাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে।সীমান্ত লাগোয়া মন্দিরগুলি নিয়েও দুই দেশের মধ্যে বার বার সংঘর্ষ বেঁধেছে।
২০১১ সালে UNESCO হেরিটেজ হিসেবে চিহ্নিত 'প্রিয় বিহার মন্দির' নিয়ে দুই দেশের সেনার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেই সময় ঘরছাড়া হতে হয় হাজার হাজার মানুষকে। কমপক্ষে ২০ জন মারা যান। চলতি বছরের মে মাসে ফের পরিস্থিতি তেতে ওঠে। কম্বোডিয়া, তাইল্যান্ড এবং লাওসের ত্রিদেশীয় সীমান্ত 'এমারেল্ড ট্রায়াঙ্গল'-এ সংঘর্ষ বাধে তাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সেনার। তাতে কম্বোডিয়ার এক সৈনিকের মৃত্যু হয়। কম্বোডিয়া সেই সময় জানায়, তারা আত্মরক্ষা করেছে মাত্র। তাইল্যান্ডই সংঘর্ষের সূচনা করে।
সেই সময় দফায় দফায় বৈঠক হয় দুই দেশের সেনার মধ্যে। পরিস্থিতি সাময়িক থিতিয়েও এসেছিল। কিন্তু সীমান্ত এলাকায় সেনা বাড়াতে শুরু করে দুই দেশই। কিন্তু অভিযোগ ওঠে, সীমান্তের একাধিক চেক পয়েন্ট তাইল্যান্ড দখল করে নিয়েছে তাইল্যান্ড। কম্বোডিয়ার জমিতে তাদেরই সেনাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি সীমান্ত সংলগ্ন কম্বোডিয়ার গ্রামগুলির বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। এর পাল্টা, তাইল্যান্ডে ফস, শাকসবজি রফতানি বন্ধ করে দেয় কম্বোডিয়া। তাইল্যান্ডের সিনেমা, সিরিয়ালও নিষিদ্ধ করা হয় দেশে।
এর মধ্যেই, ১৬ জুলাই উত্তর-পূর্ব সীমান্তে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটে। এক তাই সেনা পা হারান তাতে। তাইল্যান্ড দাবি করে, সীমান্ত এলাকায় ল্যান্ডমাইন পেতে রেখেছিল কম্বোডিয়া। অজান্তে তার উপর পা রাখায় তাদের পাঁচ সৈনিক গুরুতর আহত হয়েছেন। এর পরই সীমান্ত বন্ধ করে দেয় তাইল্যান্ড। কম্বোডিয়া থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকেও ফিরিয়ে নেয়।
এই সীমান্ত সংঘাতের জেরেই সাসপেন্ড করা হয় তাইল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন শিনাওয়াত্রাকে। কম্বোডিয়ার প্রভাবশালী নেতা হুন সেনের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ডিং ছড়িয়ে পড়ে, যাখানে হুনকে ‘Uncle’ বলে ডকতে শোনা যায় পেতংতার্নকে। হুনের ইচ্ছেপূরণ করতে প্রস্তুত বললেও জানান। এমনকি ওই কথোপকথনে তাইল্যান্ডের সেনার এক কম্যান্ডারের সমালোচনা করতে শোনা যায় পেতংতার্নকে, যা নিয়ে দেশের অন্দরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সাসপেন্ড করা হয় তাঁকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পেতংতার্ন বিবৃতি দিয়ে বলেন, “তাইল্যান্ড শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। কিন্তু কম্বোডিয়ার আগ্রাসনের উপযুক্ত জবাব দেওয়া হয়েছে।” সরকার এবং সেনার প্রতি পূর্ণ সমর্থন আছে বলে জানান তিনি।
সীমান্ত সংঘাত নিয়ে কম্বোডিয়ার তরফে বার বার রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালতের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়। কিন্তু তাইল্যান্ডের দাবি, এবিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের এক্তিয়ারই নেই আন্তর্জাতিক ন্য়ায় আদালতের।