নয়াদিল্লি: লোকসভা নির্বাচনের আগেই অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন। ভূমিপুজোর মতো রামমন্দিরের উদ্বোধনেও সশরীরে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই নিয়ে গেরুয়া (BJP) শিবির যখন উৎসাহে ফুটছে, তাদের কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন ঘিরে যতটা মাতামাতি, বিহারে সীতার জন্মস্থান বলে পরিচিত, সীতামঢ়ী নিয়ে বিজেপি 'উদাসীন' বলে তুলে ধরল তাঁর দল সংযুক্ত জনতা দল JD(U)। লোকসভা নির্বাচনের আগে হিন্দি বলয়ের রাজনীতিতে বিজেপি-র হাতিয়ার যদি রামমন্দির হয়, তার পাল্টা সীতার জন্মস্থানের প্রতি তাদের ‘উদাসীনতা’কে হাতিয়ার করে নামতে প্রস্তুত I.N.D.I.A জোটের শরিক নীতীশ। (Sita Birthplace in Bihar)
জাঁকজমক করে রামমন্দির উদ্বোধনের প্রস্তুতি চলছে এই মুহূর্তে। সেই আবহেই সীতার জন্মস্থান সীতামঢ়ীকে ঢেলে সাজাতে ৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন নীতীশ। বুধবার সেই নিয়ে নীতীশকে বলতে শোনা যায়, “দ্রুত সংস্কারের কাজ শেষ করতে হবে। সীতাকুণ্ড সংস্কারের পাশাপাশি, চারপাশের এলাকার সৌন্দর্যায়ন ঘটাতে হবে, যাতে আরও বেশি সংখ্যক পুণ্যার্থী আসতে পারেন।” শুধু ঘোষণাই নয়, বুধবার সশরীরে পুনৌরাধাম জানকী মন্দিরেও হাজির হন নীতীশ। সংস্কারকার্যের শিলান্যাস করেন নিজের হাতে। রাজ্যের মন্ত্রী বিজয়কুমার চৌধুরী, জমা খানও তাঁর পাশে ছিলেন সেই সময়। মহন্ত কৌশল কিশোররে সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষণ কথাও বলেন তাঁরা। (Ayodhya Ram Temple)
অযোধ্যার রামমন্দির বরাবরই সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি-র অ্যাজেন্ডার মধ্যে থেকেছে। তাদের মোকাবিলা করতে, ২০২৪-এর আগে, সীতার জন্মস্থানকে এবার তুরুপের তাস করতে চাইছেন নীতীশ। সেই নিয়ে পারদ চড়ছে হিন্দিবলয়ের রাজনীতিতে। বিজেপি-র দাবি, সংখ্যালঘু তুষ্টিকরণের অভিযোগ ঝেড়ে ফেলতে, নির্বাচনের আগে ‘নরম হিন্দুত্বে’র দিকে ঝুঁকছেন নীতীশ। যদিও নীতীশ এবং তাঁর সংযুক্ত জনতা দলের দাবি, ভোটবাক্সের কথা মাথায় রেখেই শুধুমাত্র রামমন্দির নিয়ে মাতামাতি করছে বিজেপি। ভগবান রামের সহধর্মিণী সীতার প্রতি গেরুয়া শিবিরের আচরণ অবহেলাপূর্ণ।এর নেপথ্যে বিজেপি-র পুরুষতান্ত্রিক, নারীবিদ্বেষী মানসিকতাও কাজ করছে বলে দাবি তোলা হয়েছে JD(U)-এর তরফে।
JD(U)-এর বিধানপরিষদীয় সদস্য তথা বিহার সরকারের ধর্ম বিষয়ক বোর্ডের সদস্য নীরজ কুমার জানিয়েছেন, নীতীশ সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাস করেন। সব ধর্মকে সমান সম্মান করেন তিনি। নীরজ বলেন, “কবরস্থানের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া বাঁধা হোক বা মন্দির অথবা অন্য ধর্মস্থানের সংস্কার, রাজ্য সরকার কোনও ভেদাভেদ করে না। সকলের উন্নয়নই সরকারের লক্ষ্য।” বিজেপি-র মোকাবিলা করতেই কি সীতামঢীকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে JD(U)? প্রশ্নের জবাবে নীরজ জানান, বিহারের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সীতার জন্মস্থান।তাঁর কথায়, “রামমন্দিরের জন্য ৩০০০ কোটি টাকা খরচ করছে কেন্দ্র। সীতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ধর্মস্থানগুলির প্রতিও সমান কদর দেখানো উচিত ছিল। আমরা সাধ্যমতো করছি। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। কারও কপিরাইট নেই ভগবানের উপর।”
যদিও বিহারে বিজেপি-র সহ-সভাপতি সন্তোষ পাঠক নীতীশ সরকারের এই উদ্যোগকে ‘নরম হিন্দুত্ব’ বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ। এর সঙ্গে সকলের গর্ব জড়িয়ে। ওরা যা করছে সেটা নরম হিন্দুত্ব। মুসলিম তুষ্টিকরণের জন্যই আসলে পরিচিত ওরা।”
পড়শি রাজ্য উত্তরপ্রদেশের তুলনায়, বিহারের রাজনীতির খোলনলচে অনেকটাই আলাদা। সেখানে রাজনীতির গতিমুখ মূলত সমাজতান্ত্রিক। হিন্দুত্ব কখনওই বিহারের রাজনীতিতে মুখ্য হয়ে ওঠেনি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বসের পরও বিহারে ভাল ফল করতে পারেনি বিজেপি। ১৯৯৫ সালের নির্বাচনে ৩২৪টির মধ্যে বিহারে মাত্র ৪১টি আসনেই জয়ী হয়েছিল তারা। একার ক্ষমতায় নির্বাচনে লড়ে বিহারে কখনও ক্ষমতাও দখল করতে পারেনি গেরুয়া শিবির। ২০১৫ সালে গোটা দেশে যখন নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, সেই সময়ও বিহারে ২৩৪টির মধ্যে ৯১টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। তবে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে কোনও ঝুঁকি নিতে নারাজ নীতীশ।
তবে নীতীশ একা নন, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি যেখানে রামমন্দিরকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তাদের মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ যেখানে রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয়েছে, তার মোকাবিলায় সীতার শরণাপন্ন হতে শুরু করেছে বিরোধী শিবিরের অন্য দলগুলিও। হরিয়ানার উপর দিয়ে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গাঁধীও সীতার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “RSS কখনও জয় সিয়ারাম বলে না। সীতাজিকে স্লোগান থেকে বাদ দিয়েছে ওরা, যা আমাদের ইতিহাসের পরিপন্থী। কোনও সঙ্ঘকর্মীকে জয় সিয়ারাম বলতে বলুন, বলাতে পারবেন না।অথচ ভগবান রামের থেকে সীতাজি কোনও অংশে কম নন।”
‘রামায়ণ সার্কিট’ এবং ‘স্বদেশ দর্শন প্রকল্পে’র আওতায় কেন্দ্রীয় সরকার যে ১৫টি পর্যটন তথা ধর্মীয়স্থানকে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে সীতামঢ়ীও রয়েছে। রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির পারস্পরিক সম্মতিতেই সেগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে দাবি কেন্দ্রের। তবে সীতামঢ়ীকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে নীতীশ সরকার। মূল মন্দিরকে ঘিরে পরিক্রমা পথ নির্মাণ করার কথা জানিয়েছে তারা। বেলেপাথরের স্তম্ভের উপর ছাদের নির্মাণ হবে। এর পাশাপাসি, একটি সীতা বাটিকা, একটি লব-কুশ বাটিকা এবং একটি শান্তি মণ্ডপও গড়ে তোলার কথা জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ক্যাফেটেরিয়া, পার্কিং লট, 3-D অ্যানিমেশন ছবি দেখানোর ব্যবস্থাও থাকবে, যেখানে সীতার জীবনী প্রদর্শিত হবে।