লখনউ: ২০১৭ সাল। তার ঠিক কয়েকবছর আগেই ২০১৪ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছিল নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি। কিন্তু তখনও দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে পারেনি বিজেপি। ২০১৭ সালে কাউকে মুখ না করেই উত্তরপ্রদেশে ভোটে লড়ে বিজেপি। সেখানে একচেটিয়া জয় পায় গেরুয়া শিবির। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন? দেশজুড়ে চলা এই প্রশ্নের মাঝেই চমক দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। গেরুয়াবসন পরা এক সন্ন্যাসীকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসায় বিজেপি। অবশ্য তার আগে থেকেই রাজনীতির অলিন্দে পদচারণা ছিল যোগী আদিত্যনাথের। একাধিবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্ররোচনামূলক নানা বক্তব্যের অভিযোগও ছিল।


ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। সেখানে এতদিন পর্যন্ত বিজেপি পরপর দুবার জিততে পারেনি। যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে সেই রেকর্ডও ভাঙল বিজেপি। মেয়াদ সম্পূর্ণ করে ২০২২ সালে ফের বিপুল ভোটে জিতে এলেন যোগী নিজে। রাজ্যজুড়েও বইল গেরুয়া ঝড়। এবারও মুখ্যমন্ত্রীর পদে যে যোগী আদিত্যনাথই বসবেন, সেটা প্রায় নিশ্চিত। মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 


কিন্তু যোগী আদিত্যনাথের পরিচয় কী? জন্মসূত্রে উত্তরাখন্ডের গাড়োয়াল অঞ্চলের বাসিন্দা অজয় সিংহ বিস্ত ওরফে যোগী আদিত্যনাথ। ১৯৭২ সালের ৫ জুন জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৯০ সালে ঘর ছাড়েন তিনি। সেইসময় দেশজুড়ে তুঙ্গে রাম জন্মভূমি আন্দোলন। তাতেই যোগ দিতে ঘর ছাড়েন তিনি। এরপর গোরক্ষনাথ মন্দিরে তাঁর পা পড়ে। সেইসময়েই গোরক্ষনাথ মঠের মহন্ত যোগী অবৈদ্যনাথের শিষত্ব গ্রহণ করেন তিনি। পরিচিত হন যোগী আদিত্যনাথ নামে।


২০১৪ সালে মারা যান মহন্ত অবৈদ্যনাথ। তারপরে গোরক্ষনাথ মন্দিরের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হল যোগী আদিত্যনাথ। এখনও পর্যন্ত সেই পদেই রয়েছেন তিনি। ওই সময়েই নিজে একটা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তোলেন যোগী আদিত্যনাথ। নাম ছিল হিন্দু যুবা বাহিনী। নিজের গ্রামের স্কুলেই পড়াশোনা শুরু হয় যোগী আদিত্যনাথের। পরে অঙ্কে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।


উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসার বহু আগে থেকেই রাজনীতির ময়দানে ছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। ১৯৯৮ সাল। গুরুর নির্দেশ মেনে রাজনীতিতে নামেন যোগী আদিত্যনাথ। মাত্র ২৮ বছর বয়সে গোরক্ষপুর কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। তারপর থেকে টানা ওই আসন থেকে জিতে সংসদে গিয়েছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত সেখানকার সাংসদই ছিলেন তিনি।


উত্তরপ্রদেশের মসনদে বসেই একাধিক সিদ্ধান্ত নেনে যোগী আদিত্যনাথ। যার ফলে দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল বিতর্ক। রাজ্যে গোহত্যা বন্ধ করেন যোগী আদিত্যনাথ। সেই কাজ বন্ধ করতে কাজে লাগানো হয় প্রশাসনকেও। ধর্মান্তর রুখতে প্রথমে অর্ডিন্যান্স এবং পরে বিল আনে যোদী আদিত্যনাথের সরকার। ভিনধর্মের বিয়ে রুখতে এমন কাজ করা হয়েছে, এমন অভিযোগও তোলা হয় বিরোধীদের তরফে। যদিও তাতে পিছু হঠেনি যোগী আদিত্যনাথের সরকার। পরে সেই মডেল অনুসরণ শুরু করে অন্য বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিও। মূলত হিন্দুত্বের মুখ হয়ে উঠতেই এমন পদক্ষেপ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।


শুধু তাই নয়, প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নানারকম প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে। অপরাধ মোকাবিলায় যোগী আদিত্যনাথের কর্মপদ্ধতি কেউ কেউ ভাল বললেও অনেকেই তীব্র বিরোধিতা করেছেন। বেআইনি বাড়ি ভাঙতে ব্যবহার হয়েছে বুলডোজার। সিএএ আন্দোলন ভাঙতেও কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন যোগী। সেগুলি নিয়েও তৈরি হয়েছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া।  


উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে লখিমপুর, হাথরসের মতো বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছিল। তারও আগে নানা অভিযোগ উঠেছিল উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের দিকে। তখন গুঞ্জন শুরু হয়েছিল যে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হতে পারে যোগী আদিত্যনাথকে। যদিও সেই গুঞ্জন উড়িয়ে বিজেপির উচ্চপদাধিকারীরা দাবি করেছিলেন উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় ফিরতে গেলে ভরসা রাখতে হবে যোগীর উপরেই। কারণ ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে জয় পেতে সেটা সবচেয়ে প্রয়োজন। সেই ভরসা প্রমাণও করলেন যোগী। রেকর্ড গড়ে দলকে ফের জিতিয়ে ফিরিয়ে আনলেন। নিজেও জিতলেন রেকর্ড মার্জিনে।   


যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে নানাভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণেরও অভিযোগ উঠেছে বারবার। কিন্তু তা যে জনমানসে কোনও প্রভাবই ফেলেনি তা ফের প্রমাণ হল উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে।


আরও পড়ুন: দ্বিতীয় বার জিতে উত্তরপ্রদেশে ইতিহাস যোগীর, '২৪-এ বিজেপি-র জয়যাত্রার পথ সুগম! চলছে জল্পনা