নয়াদিল্লি: জি-২০ সম্মেলনের জাঁকজমকের মধ্যেও নজর কেড়েছিল আড়ষ্টতা। সংবাদমাধ্যমের সামনে যখন পরস্পরকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন সকলে, চাপা উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছিল ভালই। ভারত এবং কানাডা, দুই দেশের মধ্যেকার সেই চাপা উত্তেজনাই এবার চরম আকার ধারণ করল। কানাডায় খালিস্তানপন্থী শিখ নেতার মৃত্যুতে সরাসরি ভারতের দিকে আঙুল তুলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো (Justin Trudeau)। দেশের মাটিতে ভারতীয় গুপ্তচররা হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালাচ্ছেন, যা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করে দিল্লিকে কড়া বার্তা দিয়েছে তাঁর সরকার। মঙ্গলবার আবার কানাডার কূটনীতিককে বহিষ্কার করে পাল্টা জবাব দিয়েছে দিল্লিও। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সারবত্তাহীন অভিযোগ আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে কানাডার বিরুদ্ধে। ভারত এবং কানাডার মধ্যেকার এই দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিকেও তপ্ত করে তুলেছে। আমেরিকা, ব্রিটেন-সব বিশ্বের তাবড় দেশের নজর আটকে রয়েছে ঘটনাক্রমের দিকে। (India Canada Relations)
খালিস্তান সমব্যথী, জনপ্রিয় শিখ নেতা হরদীপ সিংহ নিজ্জরের মৃত্যু ঘিরে ভারত এবং কানাডার মধ্যে সংঘাত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চলতি বছরেরে ১৮ জুন সারি-তে শিখদের একটি মন্দিরের বাইরে গুলি করে খুন করা হয় হরদীপকে। সেই ঘটনায় ভারতের গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (RAW)-এর প্রধান, ১৯৯৭ ব্যাচের আইপিএস অফিসার, দেশের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক পবনকুমার রাইকে সোমবার বহিষ্কার করেছে কানাডা সরকার। এই ঘটনায় দিল্লির ভূমিকার দিকে সরাসরি আঙুল তুলেছেন ট্রুডো।
দেশের পার্লামেন্টে ট্রুডো বলেন, “গত সপ্তাহে জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামনে বিষয়টি উত্থাপিত করি আমি। কানাডার মাটিতে, কানাডীয় নাগরিকের মৃত্যুর নেপথ্যে বহির্দেশের যোগসূত্র পাওয়া গেলে, তাতে আমাদের সার্বভৌমিকতা লঙ্ঘিত হয়, যা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই ঘটনা স্বাধীন, মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরিপন্থীও। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। সদ্য উদঘাটনে ভারত সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি আমরা। অন্য দেশের মাটিতে এই ধরনের কার্যকলাপ, যা কিনা আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থী, তা নিয়ে ভারতের অবস্থান জানতে চাই।”
কানাডার NDP নেতা জগমিত সিংহের কথায়, "সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের বিভাজনমূলক রাজনীতি, হিংসা, খুন এবং হামলার নীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আমরা। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে কড়া বার্তা দেওয়ার সময় এসেছে।" এর জবাবে দিল্লি জানায়, “দেশের পার্লামেন্টে কানাডার প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁদের বিদেশমন্ত্রী যে দাবি করেছেন, তা খারিজ করছি আমরা। ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের হিংসায় যুক্ত থাকার অভিযোগ অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকা। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র এড্রিয়েন ওয়াটসন জানান, প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো যে অভিযোগ তুলেছেন, আমেরিকা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কানাডার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। কানাডা সরকার তদন্ত চালিয়ে যাক এবং অপরাধীরা ধরা পড়ুক, এখন এটাই কাম্য। ব্রিটেনের তরফেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। দেশের এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, “অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। কানাডা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি আমরা। তদন্ত যেহেতু চলছে, এই মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করা উচিত হবে না।”
তবে একদিনে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। খালিস্তানপন্থীদের নিয়ে কানাডার সরকারের ভূমিকা নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলেছে ভারত। এমনিতে ভারত থেকে কানাডায় আশ্রয় নেওয়া শিখরা সেখানে সংখ্যায় নেহাত কম নয়। দেশের রাজনীতিতেও বেশ প্রভাব রয়েছে তাঁদের। তার মধ্যে পঞ্জাবকে টুকরো করে পৃথক খালিস্তান তৈরির দাবি তোলা খালিস্তানপন্থীরাও রয়েছেন বলে অভিযোগ। কানাডা সরকার সব জেনেও, রাজনৈতিক সমীকরণের কথা মাথায় রেখে তাদের মদত দিচ্ছে বলে অভিযোগ দিল্লির। কিন্তু কানাডায় খালিস্তানপন্থী হিসেবে পরিচিত হরদীপের মৃত্যু সেই সংঘাতকে একধাক্কায় বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে ট্রুডো সরাসরি দিল্লিকে দায়ী করায় পরিস্থিতি তেতে উঠেছে।
যে হরদীপের মৃত্যু নিয়ে এই সংঘাতের সূচনা, তিনি খালিস্তানি টাইগার ফোর্সের (KTF) প্রধান, যে সংগঠনকে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে নিষিদ্ধ করে ভারত সরকার। এ বছর ১৮ জুন সারি-তে একটি শিখ মন্দিরের সামনে গুলি করে খুন করা হয় তাঁকে। তার এক সপ্তাহ আগেই অবতার সিংহ খান্ডা নামের খালিস্তানপন্থী আরও এক নেতার রহস্যমৃত্যু হয়। লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন অবতার। ক্যান্সার ধরা পড়ার কয়েক দিনের মধ্যে হাসপাতালে বিষক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে সামনে আসে। এর পর পরই খুন হন হরদীপ। সারি-তে গুরুনানক শিখ গুরুদ্বারের প্রধান ছিলেন তিনি। ভারতে পুলিশের খাতায় নাম ছিল গহরদীপের। ২০১৬ সালে তাঁর বিরুদ্ধে নোটিসও জারি করে ইন্টারপোল। ২০১৮ সালে সারি-তেও গৃহবন্দি হয়েছিলেন, পরে মুক্তি পান।
আসলে পঞ্জাবের জলন্ধরের ভারসিং পুরার বাসিন্দা হরদীপ। ১৯৯৫ সালে কানাডা চলে যান। গোড়ায় বব্বর খালসার সদস্য ছিলেন। ২০০৭ সালে লুধিনায়ার শিঙ্গার সিনেমা হলে বিস্ফোরণে নাম জড়ায় তাঁর। ২০০৯ সালে পটিয়ালায় রাষ্ট্রীয় শিখ সঙ্গত প্রেসিডেন্ট রুলদা সিংহের খুনেও নাম জড়ায়। পাকিস্তানে গা ঢাকা দেওয়া, খালিস্তান টাইগার ফোর্স-এর তৎকালীন সুপ্রিমো জগতার সিংহ তারার কাছে প্রশিক্ষণ পান বলে জানা যায়। ২০১৪ সালে পাকিস্তান থেকে তাইল্যান্ড চলে যেতে জগতারকে হরদীপ অর্থসাহায্যও দেন।শুধু তাই নয়, পঞ্জাব থেকে ভারতে অপরাধকার্য চালানো মাফিয়া অর্শদীপ সিংহ গিলের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল হরদীপের।
কিন্তু খালিস্তান সমব্যথীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন হরদীপ। তাঁর মৃত্যুতে ভারতের হাত রয়েছে বলে আগাগোড়া দাবি করে আসছে খালিস্তানপন্থী শিখ সংগঠনগুলি। এ বছর জুলাই মাসে সেই নিয়ে টরন্টোয় হাই কমিশনের বাউরে বিক্ষোভও দেখান শতাধিক মানুষ। সেখানে ভারত এবং ভারতীয় কূটনীতিকদের উদ্দেশে লেখা, ‘Kill India’, ‘Killers’ পোস্টারও চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে বিগত কয়েক মাস ধরেই দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। হরদীপের মৃত্যুতে ভারতের হাত রয়েছে বলে ট্রুডো দাবি করায় সেই টানাপোড়েন এখন চরম আকার ধারণ করেছে, যেদিকে নজর রেখেছে আন্তর্জাতিক মহল।