নয়াদিল্লি: জাতীয় গান ‘বন্দে মাতরম’-এর সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে এবার বিশেষ আলোচনা সংসদে। ৮ ও ৯ ডিসেম্বর, সোমবার সংসদে ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে বিশেষ আলোচনার আয়োজন করা হচ্ছে, যার জন্য ১০ ঘণ্টা বরাদ্দ করা হয়েছে। সেখানে ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে অজানা ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরা হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। (Vande Mataram Discussion in Parliament)
এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য় অনুযায়ী,সোমবার দুপুর ১২টায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে বক্তৃতা করবেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহও ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে ভাষণ দেবেন লোকসভায়। রাজ্যসভায় ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে আলোচনা হবে মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর। ১০ ঘণ্টার মধ্যে ৩ ঘণ্টা বরাদ্দ হয়েছে BJP-নেতৃত্বাধীন NDA শিবিরের জন্য। (Parliament Winter Session)
সরকারপক্ষের পাল্টা ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে আলোচনায় যোগ দেবে বিরোধীরাও। কংগ্রেসের তরফে লোকসভার ডেপুটি নেতা গৌরব গগৈ, সাংসদ প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা, দীপেন্দ্র হুডা, বিমল আকোইজাম, প্রণীতি শিন্ডে, প্রশান্ত পড়োলে, চমলা রেড্ডি, জ্যোৎস্না মহন্ত আলোচনায় অংশ নিতে পারেন বলে খবর।
চলতি বছরের ৭ নভেম্বর ১৫০ বছর পূর্ণ করেছে দেশের জাতীয় গান ‘বন্দে মাতরম্’, যার অর্থ ‘মা, নতশিরে তোমার বন্দনা করি’। ১৮৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে গানটিকে যুক্ত করেন তিনি, যা ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয়। ‘বন্দে মাতরম্’ গানে সুর দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কিন্তু অতি সম্প্রতি এই ‘বন্দে মাতরম্’ গান নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। গত ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই নতুন করে বিতর্ক উস্কে দেন। ‘বন্দে মাতরম্’-এর কিছু স্তবক বাদ দেওয়ার জন্য কংগ্রেসকে দোষারোপ করেন তিনি। বলেন, “১৯৩৭ সালে বন্দে মাতরমের গুরুত্বপূর্ণ স্তবক, যা গানটির প্রাণ, সেগুলো সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বন্দে মাতরমের ওই বিভাজন দেশভাগের বীজ বপন করেছিল। আজকের প্রজন্মের জানা উচিত, জাতি গঠনের এই ‘মহামন্ত্র’-এর সঙ্গে কেন এই অবিচার করা হয়েছিল। এই বিভাজনমূলক মানসিকতা এখনও দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ।”
যদিও ইতিহাস বলছে, ১৯৩৭ সালে স্বাধীনতার স্বপ্ন যখন একটু একটু করে বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে, সেই সময় ‘বন্দে মাতরম্’কে জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করায় আপত্তি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। গানটিতে ঐক্যের বাণী নেই বলে অভিযোগ তোলেন অনেকেই। সেই আবহে জওহরলাল নেহরু রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হন। ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র বসুকে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নেহরুকে তিনি লেখেন, ‘স্বাধীনতার মঞ্চে ‘বন্দে মাতরম্’-এর অবদান, বিপ্লবী মন্ত্র হিসেবে একে অস্বীকার করা যাবে না কখনই। কিন্তু ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এটিকে দেখা যায় না। সর্বধর্মের মিলনমঞ্চ এই দেশ; আর বঙ্কিমের ওই রচনা কোনও ভাবে সেই ছবিটাকে তুলে ধরছে না’। নেতাজিকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আনন্দমঠ উপন্যাসটি সাহিত্যের বই, তার মধ্যে এই গানের সুসংগতি আছে। কিন্তু যে রাষ্ট্রসভা ভারতবর্ষের সকল ধর্মসম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র সেখানে এ গান সার্বজনীন ভাবে সংগত হতেই পারে না’।
পরে সংবাদমাধ্য়মেও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন রবীন্দ্রনাথ। জানান, ‘বন্দে মাতরম্’-এর প্রথম অংশটি সুন্দর। বঙ্গমাতা বা ভারতমাতার জন্য কোমল মধুর ভাব উদ্রেক করে। জাতীয় সমাবেশে গাওয়ার উপযোগী গানটি। কিন্তু সব ধর্মের মানুষ একত্রিত গয়ে যাদি গাইতে যান, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়াংশে ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরধারিণী কমলা কমলদলবিহারিণী’র মতো শব্দবন্ধের দরুণ আপত্তি ওঠার কথা। সেই মতে গানের দ্বিতীং অংশ বাদ দেওয়ার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে সংসদে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘জন গণ মন’ এবং ‘বন্দে মাতরম্’ দু’টি গান বাজানো হয় আজও।
নতুন করে 'বন্দে মাতরম্' বিতর্কের সময়সীমা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিহারের পর এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন বা SIR-এর কাজ চলছে। SIR-এর কাজ শেষ হলেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। মোদি নিজে বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গে জয়ের লক্ষ্য় বেঁধে দিয়েছেন নিজের দলকে। এমন পরিস্থিতিতে 'বন্দে মাতরম্' নিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবেই বিতর্ক বাঁধানো হচ্ছে বলে মত বিরোধী শিবিরের। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিষয়টি নিয়ে সরব হন। রবীন্দ্রনাথের পরামর্শেই গানের একটি অংশ বাদ যায় বলে স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।