কলকাতা ও নন্দীগ্রাম: ভোটের মুখে নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের উত্তরাধিকার নিয়ে লড়াই।     বিজেপি ও তৃণমূল দুই দলই আজ নন্দীগ্রাম দিবস পালন করছে। সকালে গোকুলনগরের অধিকারী পাড়ায় শহিদ বেদীতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন তৃণমূল নেতারা। মন্ত্রী ব্রাত্য বসু ছাড়াও এখানে ছিলেন দোলা সেন ও পূর্ণেন্দু বসু। এরপর ভাঙাবেড়া ব্রিজের কাছে শহিদ স্মরণে সভা করবেন তৃণমূল নেতা-নেত্রীরা। পাশাপাশি, বিজেপির তরফেও নন্দীগ্রাম দিবস উপলক্ষে শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। গোকুলনগরে যে শহিদ বেদিতে ব্রাত্য ও পূর্ণেন্দু বসুরা কিছুক্ষণ আগে মালা দিয়েছিলেন, সেখানে গিয়েই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করলেন শুভেন্দু অধিকারী। অন্যদিকে, নন্দীগ্রাম দিবস উপলক্ষ্যে সকাল থেকেই উত্তেজনা তৈরি হয় সোনাচূড়ায়। শুভেন্দুকে বিশ্বাসঘাতক বলে পোস্টার লাগিয়ে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল কর্মীদের একাংশ। কেন্দ্রীয় বাহিনী, র‍্যাফ ও পুলিশ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের হঠিয়ে দেয়।


নন্দীগ্রাম আবেগকে অস্ত্র করেই নির্বাচনী মহাযুদ্ধে অবতীর্ণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারী। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের কৃতিত্ব কার? তা নিয়ে চলছে তৃণমূল-বিজেপির তরজা। এরইমধ্যে আজ নন্দীগ্রাম দিবস পালন দুই দলেরই।


কার মন জুড়ে নন্দীগ্রাম রয়েছে, তা বোঝাতেই মরিয়া শুভেন্দু অধিকারী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দু মমতাকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘১৭টা অঞ্চলের মধ্যে দুটো অঞ্চলের নাম বলুন, কোভিডের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?...রেয়াপাড়াকে রিয়াপাড়া বলে।


কয়েকদিন আগে মনোনয়ন জমা দিতে তাঁর দু’দিনের নন্দীগ্রাম সফরে একবারের জন্যও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দু অধিকারীর নাম মুখে না নিলেও বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, তিনিই নন্দীগ্রাম আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন! অন্য কোনও নেতা নন। বলেছিলেন, নন্দীগ্রামে যখন জমি আন্দোলন শুরু হয়, তখন মেদিনীপুরের কোনও বড় নেতা রাস্তায় নামেননি। আমি নন্দীগ্রামে পৌঁছেছিলাম।


এই বাকযুদ্ধের মধ্যেই আজ নন্দীগ্রাম দিবস। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ।  রাজ্য রাজনীততে একটা আগুনঝরা দিন। ৩৪ বছরের বামদূর্গের ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছিল সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা। নন্দীগ্রামের মাটি থেকেই রাজ্যে বাম-ভিত দুর্বল করে  ফুটেছিল ঘাসফুল।


বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড)-এর জন্য জমি অধিগ্রহনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ঘিরেই নন্দীগ্রামে দানা বেঁধে উঠেছিল তীব্র আন্দোলন। পূর্ব মেদিনীপুরের অখ্যাত এক গ্রামের কৃষক আন্দোলনে ভিত টলে গিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের। ঘটনার সূত্রপাত ২০০৭-এর জানুয়ারি মাস। তৃণমূল সমর্থিত কৃষি জমি রক্ষা কমিটির সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের। বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছিলেন।


রাস্তা কেটে, আটকে এরপর আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধ আরও তীব্র হয়ে ওঠে।  এলাকা অবরোধমুক্ত করতে ২০০৭-এর ১৪ মার্চ বিশাল পুলিশ বাহিনী দুদিক থেকে নন্দীগ্রামের দিকে এগোতে শুরু করে। আন্দোলনকারীরা পুলিশের অগ্রগতিতে বাধা দেয়। তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশ গুলি চালায়। নির্বিচার গুলি বর্ষণে ১৪ জনের মৃত্যু হয়।  সিপিএমের ক্যাডারবাহিনীও পুলিশের সঙ্গে ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে নন্দীগ্রামের মাটি। আন্দোলনকারীদের রক্তাক্ত প্রতিরোধে ব্যর্থ হয় পুলিশের অভিযান।


নন্দীগ্রামে এই হত্যাকাণ্ডে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী তীক্ষ্ণভাষায় এর নিন্দা করেন।পথে নামেন বিশিষ্টরাও।   নন্দীগ্রাম আন্দোলন বাম শাসনের পতনের পথ ত্বরাণ্বিত করে।


১৪ মার্চের ঘটনার পর ২০০৯-এ নন্দীগ্রাম বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হয়। সিপিআই বিধায়কের পদত্যাগের ফলে এই উপনির্বাচন হয়েছিল। এই উপনির্বাচনের মাধ্যমেই জয়যাত্রা শুরু হয় তৃণমূলের। তৃণমূল প্রার্থী নন্দীগ্রাম আন্দোলনে নিহতের মা  ফিরোজা বিবি ৩৯,৫৪৯ ভোটে সিপিআই প্রার্থীকে হারিয়ে দেন তৃণমূল প্রার্থী। ফিরোজা বিবি পেয়েছিলেন ৯৩,০২২ ভোট (৫৮.২৮ শতাংশ)। সিপিআই প্রার্থী পেয়েছিলেন ৫৩,৪৭৩ ভোট (৩৯.৩৫ শতাংশ)।


২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিজয়রথে এই আসনেও ধরাশায়ী হয় বামেরা। এই আসনে   ৬১.২১ শতাংশ ভোট পেয়ে জেতেন ফিরোজা বিবি। ৪৩,৬৪০ ভোটের ব্যবধানে তিনি হারান সিপিআই প্রার্থী পরমানন্দ ভারতীকে। ফিরোজা বিবি পান ১,০৩,৩০০ ভোট। সিপিআই প্রার্থী পেয়েছিলেন ৫৯,৬৬০ ভোট। শতাংশের হিসেবে ৩৫.৩৫ শতাংশ। ওই নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী বিজন কুমার দাস পেয়েছিলেন মাত্র ৫,৮১৩ ভোট। শতাংশের হিসেবে ১.৭২ শতাংশ।


২০১৬-র নির্বাচনে এই আসনে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। ভোটের ফলাফল বেরোলে দেখা যায়, তৃণমূল প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান আরও বেড়েছে। ৮১,২৩০ ভোটে শুভেন্দু হারান সিপিআই প্রার্থী আব্দুল কবির শেখকে। শুভেন্দু পেয়েছিলেন ১,৩৪,৬২৩ ভোট (৬৭.২০ শতাংশ)। সিপিআই প্রার্থী পেয়েছিলেন ৫৩,৩৯৩ ভোট (২৬.৭০ শতাংশ)। বিজেপি প্রার্থী বিজন কুমার দাস পেয়েছিলেন ১০,৭১৩ ভোট (৫.৪০ শতাংশ)।


২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে দেশজুড়ে মোদি-ঝড়ের রেশ এসে পৌঁছয় তমলুক আসনের অন্তর্গত নন্দীগ্রামেও। তমলুক লোকসভা আসনে তৃণমূল জিতলেও বিধানসভাওয়ারি ফলাফলে নন্দীগ্রামে ভোট অনেকটাই বাড়িয়ে নেয় বিজেপি। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে বিজেপি যেখানে হাজার দশেক ভোট পেয়েছিল, সেখানে লোকসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রামে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৬২ হাজারের বেশি বাড়ে।  ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম থেকে তৃণমূলের লিড কমে হয় প্রায় ৬৮ হাজার। লোকসভা ভোটের ফল অনুযায়ী, তৃণমূল পেয়েছিল  ৬৩.১৪ শতাংশ ভোট। আর বিজেপির প্রাপ্ত ভোট বেড়ে হয় ৩০.০৯ শতাংশ৷ বলাই বাহুল্য, একদা বাম দূর্গে বামেদের রক্তক্ষরণ অব্যাহত।


বিজেপির এই বাড়বাড়ন্তের মধ্যেই নন্দীগ্রাম বিধানসভা আসনের রাজনৈতিক সমীকরণও এবার বদলে গিয়েছে। রাজ্য বিধানসভা ভোটের আগে নন্দীগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শুভেন্দু ইস্তফা দেন। তৃণমূল ছেড়ে হাত ধরেছেন পদ্মের।


এরপরই গত জানুয়ারিতে নন্দীগ্রামে গিয়ে জনসভায় ওই আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার কথা জানান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দুর দূর্গে গিয়ে এভাবে তাঁর চ্যালেঞ্জ ছোড়ার কৌশল ঘিরেও রাজনৈতিক মহলে জোর চর্চা শুরু হয়। শুভেন্দু মমতাকে ৫০ হাজারের বেশি ভোটে হারানোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।


চাপানউতোরের মধ্যেই দলের প্রার্থীতালিকা ঘোষণার সময় মমতা জানান, তিনি কথা দিলে কথা রাখেন। নন্দীগ্রাম থেকেই এবারের ভোটে লড়াইয়ের ঘোষণা করেন তিনি।


শুভেন্দু ওই আসনে বিজেপির প্রার্থী হবেন কিনা, তা নিয়ে জোর জল্পনা শুরু হয় রাজনৈতিক মহলে। অবশেষে বিজেপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর জল্পনার অবসান হয়। নন্দীগ্রামে মমতা-শুভেন্দু মেগা-দ্বৈরথের পটভূমি তৈরি হয়।


ইতিমধ্যেই মনোনয়ন দাখিল করেছেন দুই হেভিওয়েট প্রার্থী। মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন মমতার আহত হওয়ার ঘটনা ঘিরে উত্তাপ ছড়িয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে।


এই আসনে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের প্রার্থী সিপিএমের যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়।


আগামী নির্বাচনে এই হেভিওয়েট-টক্করে ভোটের অঙ্কে পাল্লা কার দিকে ঝোঁকে, এখন সেদিকেই তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল।