আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবার লড়াই সেয়ানে-সেয়ানে। এবারের ভোটে আমেরিকার ভোটদাতারা কার্যত আড়াআড়ি বিভক্ত। ভোটদাতাদের অর্ধেক চান ডোনাল্ড ট্রাম্প জমানার দুঃস্বপ্নের অবসান হোক। অপর অর্ধাংশের মনস্কামনা ট্রাম্পের উগ্রজাতীয়তাবাদী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য বজায় থাকুক। তাঁর নেতৃত্বেই আমেরিকা জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখুক।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ফিরতে চলেছেন নাকি রিপাবলিকান প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হবেন জো বাইডেন, তা এখনও নিশ্চিত হয়নি। একাংশের মতে ট্রাম্প বিরোধী হাওয়া এবার নানা কারণে জোরালো। বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, মেক্সিকানদের ধর্ষণকারী আখ্যা দেওয়া, ট্রাম্পের কর ফাঁকি এসব ভোট ময়দানের ইস্যু। এমনকি করোনা ভাইরাস সামলানোর ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের ভূমিকা বড়সড় প্রশ্নের মুখে। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর নিরিখে আমেরিকা এখনও বিশ্বে প্রথম স্থানে।প্রতিদিন প্রায় এক হাজার জন করে মারা যাচ্ছেন। এই সেদিনও এক লক্ষ লোক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তা সত্ত্বেও করোনা নিয়ে ট্রাম্পের ঢিলেঢালা মনোভাব। এমনকি মাস্ক পরা নিয়েও তিনি মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছেন। বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র, যে প্রায়শই সংবাদ শিরোনামে থাকে করোনার ক্ষেত্রে সে দেশের এমন বেসামাল অবস্থা গোটা বিশ্বের কাছে চর্চার বিষয়। অথচ যে ভিয়েতনাম ও কিউবাকে আমেরিকা নানা ধরনের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক চাপের বেড়াজালে রাখে, তারা কোভিড ১৯ রুখতে অনেেক বেশি কার্যকর পদক্ষেপ করেছে।

মার্কিন নাগরিকদের একাংশের কাছে ট্রাম্পের চার বছরের শাসন ’ দুঃস্বপ্নের রাত‘। কুকথার রাজনীতিতেও ট্রাম্পের ভাবমূর্তি বারবার ধাক্কা খেয়েছে। কম করে ২০ জন মহিলা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর নারী বিদ্বেষ, মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ, বিদেশিদের প্রতি অহেতুক ভয় এমন নানান কারণে ট্রাম্পের নেতিবাচক ভাবমূর্তি দিনকে দিন জোরালো হয়েছে।

ট্রাম্পের এইসব আচরণ নিয়ে সমালোচনার ঝড়় কম ওঠেনি। কিন্তু ট্রাম্প পাল্টাননি। সম্ভবত সে কারণে একাধিক জায়গায় জো বাইডেন বলেছেন, আমেরিকার নাগরিকরা শিষ্টাচারে বিশ্বাসী, সম্মানজনক জনতা। ভোটের আগের দিন পর্যন্ত আমেরিকাবাসীর মনে এবার একটা অন্য প্রতিক্রিয়া ছিল বলেই মনে করেন অনেকে। প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাট পদপ্রার্থী জো বাইডেন বলেছিলেন, ’’এটা বিষয় নয় যে আমরা কারা, এটাও বিষয় নয় যে আমেরিকা কী।‘‘ বাইডেন যা বলতে চেয়েছিলেন, তা এক ভোটারের কথায় উঠে এসেছে। জনৈক ভোটারের মতে, ’’এই নির্বাচন দুটি বিপরীত চিত্রকে তুলে ধরেছে। মার্কিন ভোটারদের একটা বড় অংশ চান ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করতে। আরেকটি অংশ আবার রিপাবলিকানদের পক্ষে। ট্রাম্প এতদিন ধরে যা কিছুই করে গিয়েছেন, তাঁরা তার সমর্থক। এই ভোটে আমেরিকার ভোটদাতারা সরাসরি দুটি অংশে বিভক্ত। সেই কারণে লড়াই এবার হাড্ডাহাড্ডি।‘‘

এবারের ভোট নিয়েও জনমানসে একটা আতঙ্ক ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন আমেরিকার ভোটে এবার হিংসা ছাপ ফেলবে। যদিও শেষমেষ ভোটদান পর্বে তা হয়নি। জো বাইডেন যথার্থই বলেছেন ’শিষ্টাচার নিয়ে এই গণভোট‘।

কিন্তু হিংসার আশঙ্কা বোধহয় একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রকাশ্য বার্তায় ডোনাল্ড ট্রাম্প বলতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি জিতে গিয়েছেন। কোটি কোটি মানুষ তাঁকে ভোট দিলেও একদল মানুষ তা মেনে নিচ্ছেন না। সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। জানিয়ে রেখেছেন পরাজয় তিনি মনে নিচ্ছেন না। একই কথা জানিয়েছেন জো বাইডেনও। হোয়াইট হাউসের আসনে কি ট্রাম্প ফিরতে চলেছেন নাকি ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর জয়ডঙ্কা বাজবে জানতে আর কিছু সময়ের অপেক্ষা।

বাইডেন অনেকবারই বলেছেন, মার্কিন জনগণ মনেপ্রাণে ভদ্র, সম্মান করার মতো মানুষ। ভোটের আগের দিন যে বিদ্বেষ, বাগাড়ম্বর, তিক্ততা এবারের নির্বাচনকে চিহ্নিত করেছে, সাম্প্রতিক কালে ডেমোক্র্য়াট ও রিপাবলিকান বিভাজনে মার্কিন রাজনীতিকেও বিষিয়ে তুলেছে, তার উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, আমরা কে, আমেরিকা কী, সেটা বিষয় নয়। এবারের নির্বাচন ঠিক তার উল্টোটা তুলে ধরেছে। যদিও কেউ এটা ভেবে আহ্লাদিত হতে পারেন যে, ভোটদাতাদের অর্ধেক ট্রাম্প এবং তিনি যে ভাবনার প্রতিনিধিত্ব করেন, তাকে খারিজ করেছেন, বাকি অর্ধেক কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির নৃশংস চেহারাটা দেখিয়েছে। এরা এমন একটি দল যারা ঐশ্বর্যের উত্কট বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, উগ্র জাতিবিদ্বেষ পোষণ করে, অ-শ্বেতাঙ্গ এলিটদের প্রতি ঘৃণা পুষে রাখে, নারীবিদ্বেষ, উগ্র পৌরুষে বিশ্বাস করে, নিশ্চিত করতে চায় যে, সাদা এলিটরা আমেরিকান সমাজে নিজেদের দাপট বহাল রাখবে, আমেরিকা গোটা দুনিয়ায় দাদাগিরির ছড়ি ঘোরাবে। কিন্তু এটাই যদি মার্কিন জীবনধারার রূপ, চেহারা হয়, তবে গোটা দুনিয়ার উচিত একযোগে তাকে সোজাসুজি প্রত্যাখ্য়ান করা। ২০২০ র প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যা দেখিয়েছে, সেটা হল, বাকি বিশ্বের আমেরিকামুখী হওয়ার কোনও কারণ, প্রয়োজনই নেই। আমেরিকাকে বাদ দিয়েই তারা নিজেদের কল্পনাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে দিক।