কলকাতা: 'দুস্তর শৈলের বক্ষে প্রস্তরের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়, বিজয়-আখ্যানলিপি লিখি দিলে পল্লব-অক্ষরে/ ধূলিরে করিয়া মু্‌গ্ধ, চিহ্নহীন প্রান্তরে প্রান্তরে, ব্যাপিলে আপন পন্থা'...


১৩৩৩ এর ৯ চৈত্র, শান্তিনিকেতনে বসে 'বৃক্ষবন্দনা' রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকৃতি চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে একের পর এক রচনা করে গিয়েছেন তিনি, নিঃসন্দেহে প্রকৃতিপ্রেমিক 'বলাই' তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রাচ্যর এই দেশ সে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলেছে না কি স্থবির, তা প্রশ্নাতীত। কিন্তু শান্তিনিকেতন থেকে বহু দূরের গ্রাম গুব্বি তালুকে জন্মগ্রহণ করা এক মহিলার রন্ধ্রে যেন বলাইয়ের সুর প্রবহমান। আজ তাঁর বয়স ১১২ বছর। কিন্তু গাছ ভালবেসে তিনিই 'ভারতের বৃক্ষ-মাতা', তিনি সালুমারাদা থিম্মাক্কা। 


২০২৩ এ দাঁড়িয়ে তাঁকে আলাদা করে পরিচয় করানো ধৃষ্টতা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও তিনি সমভাবেই জনপ্রিয়। কাজের হিসেবে তাঁর ব্যপ্তি বটবৃক্ষের মতোই। আজ 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস'-এ তাই যে নাম প্রথমে মনে আসে- তিনি 'সেঞ্চুরি' পেরনো সালুমারাদা থিম্মাক্কা। 


জন্মসূত্রে কর্নাটকের তুমুকুরি জেলার বাসিন্দা তিনি। কোনও প্রথাগত শিক্ষা তাঁর নেই, পেশা ছিল দিনমজুরি। বিয়ের পর সন্তানাদি না হওয়ায় গাছকেই সন্তান করে নিয়েছিলেন সালুমারাদা। যদিও এই নাম তাঁর বৃক্ষপ্রেমী হওয়ার পরই পাওয়া। জন্মগত সূত্রে তিনি ছিলেন- আলা মারাদা থিম্মাক্কা। পরবর্তীতে তাঁর বৃক্ষ প্রীতি এবং নিরন্তর কাজ তাঁকে 'সালুমারাদা' নামই দেয়। যার অর্থ- গাছেদের সাড়ি। এই নাম, আজকের প্রতিপত্তি, একদিনে পাননি ১১২ বছর বয়সি। তা পাবেন বলেও কাজ শুরু করেননি। ভালবাসা থেকেই শুরু করেছিলেন বৃক্ষরোপণ। আজ সেই সব মহীরূহরাই দু'হাত ভরে ভরিয়ে তুলেছেন তাঁকে। 


কাজ শুরু করেছিলেন গ্রাম থেকেই। থিমাক্কা এবং তাঁর স্বামী দেখেছিলেন যে তাঁদের গ্রামে অনেক বট গাছ থাকলেও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সে গাছ প্রায় নেই বললেই চলে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। বট গাছ থেকে চারা কলম বানিয়ে পার্শ্ববর্তী কুদুর গ্রামের কাছে ৫ কিলোমিটার দূরে দূরে বট চারা রোপণ শুরু করলেন তাঁরা। দ্বিতীয় বছরে ১৫টি চারা, তৃতীয় বছরে ২০টি চারা রোপণ করেন। তাঁদের সন্তানস্নেহে লালন করতে প্রতিদিন কিলোমিটারের পর কিলোমিটার যেতেন তাঁরা। এমনকি, চারা অবস্থায় গাছগুলির যাতে ক্ষতি না হয়, বেড়া দিয়ে গণ্ডিও দিয়ে যেতেন। কোনও সরকারি সাহায্য কিংবা আত্মীয়-পরিজনদের সাহায্যে নয়, নিজেদের সঞ্চয় দিয়েই ৩৮৪টি গাছের লালন-পালন করে চলেছিলেন থিমাক্কা। ১৯৯১ সালে মারা যান স্বামী। একা হয়ে পড়লেন থিমাক্কা। পাশে আছে তাঁর গাছেরা। তাই দুঃখকে ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যোগে গাছ রোপণ, লালন-পালন, সেবা- শুরু করলেন। বর্তমানে ৮০০০টি গাছের 'মা' তিনিই।


তবে 'মা' হওয়া তো মুখের কথা নয়! থিমাক্কার এই যাত্রাপথও যে খুব সহজ ছিল তা নয়। ২০১৯ এ বাগেপল্লী-হালাগুরু রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য তাঁর রোপণ-লালন করা সন্তানসম ৩৮৫টি বটগাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্নাটক সরকার। মায়ের মন আকুল হয়েছিল। অদৃষ্টে হয়তো দেখেছিলেন ঈশ্বরও। তাই পুনর্বিবেচনা করেই সে গাছগুলিকে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্য নেওয়া হয় রাজ্য সরকারের তরফে। শতক পেরনো বৃদ্ধার থেকে লালনের দায়িত্ব নিয়ে কর্নাটক সরকারই সে কাজ করে চলেছে এখন। 


আরও পড়ুন, 'ভেবেছি যত পারি গাছ রেখে যাব...', পরিবেশ বাঁচাতে গাছ পোঁতাই নেশা শ্যামলের


পৃথিবী থেকে যখন কমছে সবুজ, গাছ কেটে তৈরি হচ্ছে একের পর এক প্লট, বিশ্ব উষ্ণায়নে যখন গলছে অ্যান্টার্কটিকার হিমবাহের একাংশ, চড়চড়িয়ে বাড়ছে পারদ, পুড়ছে অ্যামাজনের মতো জঙ্গল, জলস্তর বাড়ছে সমুদ্রের, তখনও নিবীড় মনে চারা পুঁতে চলেছেন সালুমারাদা। সারাজীবনের কাজ তাঁকে দিয়েছে দেশ ও বিদেশের একাধিক সম্মান, পুরস্কার, পদ্মশ্রী, অর্থ। সম্পত্তি পেরিয়েছে কোটির গণ্ডি। একশো বছর পেরনো শরীরে এসেছে রোগ-ব্যাধির হাতছানি। বয়সের ভারে আজ 'বৃক্ষ-মাতা' রুগ্ন। কিন্তু গাছেদের অক্সিজেনেই হয়তো আজও তিনি প্রাণ পেয়ে চলেছেন। আজকের যুবক-যুবতীদের প্রতিদিন বুঝিয়ে চলেছেন- কেন এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে গাছেদের প্রয়োজন? কেন একটি গাছ, একটি প্রাণ? 


যশ-প্রতিপত্তি-পুরস্কার-অর্থ- পৃথিবীর জাগতিক সবকিছুই তাঁর আছে বর্তমানে। কিন্তু সালুমারাদা থিম্মাক্কা যেন সেই মাটিরই মেয়ে যে মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে বেড়ে ওঠে তাঁর সন্তানসম বৃক্ষেরা। শতকোর্ধ্ব বৃদ্ধাকে যেন আজও আগলে রেখেছে সেই শাখাপ্রশাখারা। 'বিশ্ব পরিবেশ দিবসে' তাই যে নাম সর্বাগ্রে মনে আসে সেই সালুমারাদা থিম্মাক্কা যেন সব প্রাণের জীবন শক্তিতে হয়ে উঠুন 'বিশ্বের বৃক্ষ-মাতা'।