চিনের তথাকথিত ‘এক দেশ দুই সিস্টেম’ ধাঁচের শাসন বানচাল করার চেষ্টার বিরুদ্ধে হংকঙে ৫ মাসের চলতি প্রতিবাদ-বিক্ষোভ যে জন প্রতিরোধের বিশ্ব ইতিহাসে এক তুলনামূলক নতুন, তবে অনিশ্চিত পর্বের সূচনা করেছে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। এই আন্দোলনের সঙ্গে সত্যই এমন কারও যোগ দেখানো যায় না যাকে ব্যাপক স্বীকৃতি পাওয়া নেতা বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যদিও আন্তর্জাতিক মহল এই আন্দোলনের ব্যতিক্রমী গুরুত্ব উপলব্ধি করছে ধীরে ধীরে, এটা মাথায় রাখা উচিত যে, এই আন্দোলন আবেগের দিক থেকে নৈরাজ্যবাদী এবং রাষ্ট্রের তরফে বিরাট প্ররোচনা, কখনও কখনও আকস্মিক হিংসা মাথাচাড়া দেওয়া সত্ত্বেও মোটের ওপর অহিংসই থেকেছে।


এটাও স্পষ্ট বলতে চাই যে, ‘নৈরাজ্য’ বলতে আমি কিন্তু আইনশৃঙ্খলার অনুপস্থিতি নয়, বরং শব্দটির প্রকৃত অর্থ মানে, ক্ষমতার আমূল বিভাজনক বোঝাতে চাইছি। এই বিদ্রোহের ফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না, তবে এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আগামী ২ বছরের মধ্যে অনুভব করা যাবে এবং শুধুমাত্র হংকং বা চিনে। অহিংস ও অসামরিক প্রতিরোধের ইতিহাসকে বর্তমান ভাষ্যে নতুন এক অধ্যায় যোগ করতে হবে। যারা অত্যাচারী রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপকে প্রতিরোধের রাস্তা খুঁজছেন, তাঁদের সামনে বাহবা দেওয়ার মতো শিক্ষা রয়েছে এই আন্দোলনের। আমার সন্দেহ, সর্বত্র রাষ্ট্রগুলো হংকঙের ঘটনাবলীর দিকে ভয়, উদ্বেগ সহকারে নজর রাখছে। এই বিদ্রোহ দমনে চিনের হতবাক করা ব্যর্থতায় তারা শঙ্কিত। এমন নয় যে, চিন ক্ষমতার নৃশংস প্রয়োগ করতে চলেছে। কিন্তু হংকঙের বিদ্রোহীদের নিশ্চয়ই তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের পরিণতি মাথায় রাখতে হবে। সেই দমনপীড়নে কয়েকশ, সম্ভবত হাজারে হাজারে চিনা নাগরিক হয় নিহত অথবা বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন। জিনজিয়াং প্রদেশে চিনারা লাখখানেক মুসলিমকে তথাকথিত পুনঃশিক্ষাদান শিবিরে পুরেছে। সমালোচকদের মত, ওগুলো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। চিন বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের লাগাতার খুঁজে বের করে, সে তাঁরা যেখানেই থাকুন না কেন। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের তার হাতে তুলে দিতে অন্য দেশগুলো চমকে-ধমকে রাখার কোনও চেষ্টাও বাকি রাখেনি চিন। এর মধ্যে যে ‘এশিয় মূল্যবোধ’ই থাকুক না কেন, চিন বিরুদ্ধ মত দমনে, ‘আইন শৃঙ্খলা’ রক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্মম, নিষ্ঠুর।


তবে কেন এখনও চিন হংকঙের বিদ্রোহ দমনে স্পষ্ট, নির্নায়ক পদক্ষেপ করেনি, সেই প্রশ্নটা অ্যাকাডেমিক গুরুত্বের চেয়েও বড়। অর্থনীতিবিদদের মত, চিনে যখন অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তখন সে অন্য দেশগুলি, বিশেষত পশ্চিমী দুনিয়াকে চটাতে পারে না। হংকং দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আর্থিক বাজারের অন্যতম। ওখানকার স্টক এক্সচেঞ্জ লন্ডনের চেয়ে বড়। সুতরাং নিজেদের স্টক এক্সচেঞ্জে বিঘ্ন ঘটার মতো কিছু না করলেই বুদ্ধির পরিচয় দেবে চিন। শুল্ক নিয়ে চিন, আমেরিকার চলতি সংঘাত নিয়ে বেশি বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। তবে এটা বিশ্বাস করাও বিভ্রম যে, আর্থিক পদক্ষেপ যুক্তির রাস্তায় চলে।

আরেকটা জোরালো যুক্তি হল, চিন কয়েকটি দশক ধরে নিজেকে এক দায়িত্বশীল বিশ্বশক্তি হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছে এবং সে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা মার খেতে পারে, এমন কিছু করতে দ্বিধাগ্রস্ত। এধরনের মত, বিস্ময়কর নয় যে, উঠে আসে সেইসব পশ্চিমী শক্তির মাটি থেকে যারা ভাবে, তারা নিজেরা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ আচরণের আদর্শ নমুনা। এদের নেতৃত্বে আছে আমেরিকা, যে ভাবে যে, সে এক ‘দায়িত্বশীল’ বিশ্বশক্তি। তো দায়িত্বশীল শক্তি হিসাবে সে যদি একাধিক অন্যায় যুদ্ধ চালাতে, দেশে দেশে হানা দিতে, গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত সরকারকে উত্খাতে অভ্যুত্থান ঘটাতে, বহু আন্তর্জাতিক চুক্তিতে অন্তর্ঘাত চালাতে ও একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করতে পারে, তবে দায়িত্বজ্ঞানহীন শক্তি হিসাবে সে যে কী করতে পারে, সেটা কল্পনা করলে আতঙ্কে শিউরে উঠতে হয়।

আরও একটা মত রয়েছে যে, হংকঙে হঠকারী পদক্ষেপ নিলে তাইওয়ানের সঙ্গে চিনের বহু পুরানো সংঘাত চিরতরে মেটানো ও তাকে মূল ভূখন্ডে অন্তর্ভুক্তির প্রয়াসে নেতিবাচক ফল হতে পারে। এই মতে হয়তো কিছুটা যুক্তি আছে। কিন্তু যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে, প্রতিরোধ আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে চিন সরকারের ব্যর্থতার কারণেই চিন হংকঙের বিদ্রোহ মোকাবিলায় নির্নায়ক পদক্ষেপ গ্রহণে ইচ্ছুক নয়, তবে? হিংসার মোকাবিলা কীভাবে হয়, সরকারগুলি ভাল করেই জানে, কিন্তু অহিংস আন্দোলন বিরোধীকে ধাঁধায় ফেলে, নিরস্ত্র করে।
বর্তমান আন্দোলনের অতীত রয়েছে সেই ২০১৪ এর আমব্রেলা আন্দোলনে, আরও স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবিতে যার সূচনা হয়েছিল। গোটা আন্দোলনের চরিত্র মূলত অহিংসই ছিল। ২০১৯ এর প্রতিবাদ আন্দোলন ইতিমধ্যেই আগের বিক্ষোভ-প্রতিবাদগুলিকে ছাপিয়ে গিয়েছে এবং তার ব্যাপ্তি, গভীরতা, সুযোগ-সম্ভাবনাও ভিন্ন মাত্রার। গত মাসে কোনও একটা রবিবারের দুপুরের প্রতিবাদী জমায়েতে প্রায় ২ লাখ লোকের সমাবেশ হয়েছিল শহরের ভিক্টোরিয়া পার্কে।



এই প্রতিবাদের সূচনা হয়েছিল প্রত্যর্পণ বিলের বিরোধিতায়। কিন্তু তার পরের মাসগুলিতে দাবির বহর বেড়ে শুধুমাত্র কয়েক গুণই হয়নি, একেবারে অপ্রত্যাশিত ভাবে উবেও গিয়েছে। বিক্ষোভ থেকে নির্বাচন পরিচালনার কায়দায়, সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মৌলিক সংস্কারের দাবি তোলা হয়েছে। সব রাজনৈতিক বন্দিকে ক্ষমার দাবিও উঠেছে। কিন্তু অস্বাভাবিক ভাবে, তারা এও দাবি করেছে, গত ১২ জুনের ব্যাপক বিক্ষোভকে ‘দাঙ্গা’ তকমা দেওয়া যাবে না। সেদিনই বিলটি নিয়ে আইনসভায় দ্বিতীয়বার আলোচনার কথা ছিল। কিছু প্রশাসনিক কর্তারক কাছে দাবিটা খাপছাড়া লাগতে পারে বটে, কিন্তু উপনিবেশবাদের একজন পড়ুয়ার কাছে মোটেই বিস্ময়কর নয় যে ভাল করে জানে যে, উপনিবেশ রাষ্ট্র ক্রমাগত রাজনৈতিক প্রতিবাদকে মামুলি অপরাধ বলে দেখানোর চেষ্টা করে।

এই প্রতিবাদের মধ্যে আরও অনেক কিছু আছে যা রাষ্ট্রের কর্তাদের কী করে এই বিদ্রোহ ও তার ‘উসকানিদাতাদের’, যদি তেমন কেউ থেকেও থাকে বা, সামলানো যায়, সে ব্যাপারে দিশাহীন করে দিয়েছে। কেননা এই আন্দোলনে বেশ কিছু অভিনব দিক, কৌশল-পন্থা দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের প্ররোচনার জবাবে বিক্ষোভকারীরা গভীর সংযম দেখিয়েছে, কাঁদানে গ্যাসের ক্যানিস্টারকে নিষ্ক্রিয় করেছে জলের বোতল দিয়ে। গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার আগে তা বের করে দিয়েছে ট্রাফিক কোন ব্যবহার করে। হাতের মুদ্রা দেখিয়ে আসন্ন পুলিশি ব্যবস্থার ব্যাপারে আগাম বার্তা পাঠিয়েছে। বহু ব্যবহারে কথাটা ক্লিশে শোনালেও এগুলি সবই হিমশৈলের চূড়ামাত্র। আমরা হংকঙে যা দেখছি, সেটা গণ অহিংস বিক্ষোভের এক নতুন নির্মাণের ছবি। যে রাজনৈতিক বিদ্রোহীরা নীচুতলা থেকে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার বাসনা পোষণ করেন, তাঁরা হংকঙের প্রতিবাদকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে ভাল করবেন।

বলতে গেলে দুনিয়ার প্রায় সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত, তরুণতর গণতন্ত্রও আক্রমণের মুখে। কেউ কেউ পর্বটাকে ‘স্ট্রং মেন’ বা শক্তিশালী ব্যক্তির সময় বলে চিহ্নিত করতে চান। যেমন, নরেন্দ্র মোদি, ডোনাল্ড ট্রাম্প, রিসেপ এরডোগান, জেয়ার বোলসোনারো, ভিক্টর ওরবান, বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু, রোডি দুতার্তে। আছেন শি জিনপিংও যিনি প্রেসিডেন্ট পদের সময়সীমা, মেয়াদ ঘুচিয়ে দিয়ে নিজেকে চিনের আজীবন প্রেসিডেন্ট হিসাবে কায়েম করেছেন। মাওয়ের ব্যাগি ট্রাউজার বা চেনা ইউনিফর্মের শি-র কাজে আসে না, তিনি স্যুট পরিহিত। যে অসংখ্য টেকনোক্র্যাট, ম্যানেজার পদে থাকা এলিটজন রয়েছে, তাদের সঙ্গে শি-কে গুলিয়ে ফেলা যায়। এমনকী নিজেকে তিনি মাওয়ের বৌদ্ধিক উত্তরসূরী বলেও কল্পনা করে থাকেন। কট্টর পার্টি-অনুগামী, স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যে ‘শি জিনপিং চিন্তা’-কেও ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। আমাদের সময়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বর্ণনায় ‘পপুলিজম’ শব্দটা ব্যবহার হওয়াই ঠিক, যদিও অল্পসংখ্যক বিশ্লেষকই এই ‘পপুলিজম’-এর নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করার ব্যাপারে থমকে গিয়েছেন। মনে হয়, আর ক’বছর পর গণতান্ত্রিক ও একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রের পার্থক্য নির্ধারণের বৈশিষ্ট্য খুব কমই অবশিষ্ট থাকবে।



বিরুদ্ধ মত টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশিরভাগ দেশেই অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে এসেছে। অহিংস রাজনৈতিক কর্মী ও গণ প্রতিবাদীদের আগের প্রজন্মরা মিডিয়াকে বেশ কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। পাবলিসিটি ছিল তাঁদের অক্সিজেন। এমনকী এই যুক্তিও দেওয়া যেতে পারে যে, গাঁধীর ভারতে বা ৬০-এর দশকে জিম ক্রো-র দক্ষিণে জেল ভরো-র মতো কৌশল প্রেসের আগ্রহ সৃষ্টির কথা মাথায় রেখেই নেওয়া হয়েছিল। (তবে এমন ধারণা খুব সহজে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত, কেননা গাঁধী, কিং, জেমস লসন, ম্যান্ডেলা, ওয়াল্টার সিসুলু, আহমেদ কাথরাডার ও আরও অনেকে ছিলেন ইনস্ট্রুমেন্টাল যুক্তিবাদের ধারণার কট্টর সমালোচক।)

সমালোচকরা দেখাতে পারেন যে, মিডিয়া আজকাল অহিংস সমাজকর্মীদের আরও হাতের নাগালে। কিন্তু বাস্তব এ থেকে অনেক ভিন্ন। রাষ্ট্র সর্বত্র মিডিয়াকে নিজের স্বার্থে শাসন করার মতো উল্লেখযোগ্য জেদ, শক্তি, ইচ্ছা দেখিয়েছে। আর এ যুগে সত্যই প্রথম বলি হয়। সত্য অহিংস ভাবধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত। হংকং শুধুমাত্র আমাদের পথে প্রতিবাদের একটা নতুন আর্কিটেকচার বা কাঠামোই উপহার দেয়নি, যা পোস্ট-ট্রুথ পর্বে এই প্রথম, আমাদের এই বিষয়ের প্রতিও সতর্ক করেছে যে, বিরুদ্ধ মতপ্রকাশের প্রশ্নটি হবে আমাদের সময়ের মুখ্য বিষয়।