ওয়াশিংটন: চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানকে চটানো সম্ভব ছিল না। তাই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পাক সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৃশংস অত্যাচারের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেনি আমেরিকা। এমন কথাই জানিয়েছেন প্রাক্তন মার্কিন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জার। দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে কিসিঞ্জার বলেছেন, আমেরিকার চাপের মুখে ১৯৭১-র নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এর এক মাস পরেই আচমকা পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। এর ফলে বাধ্য হয়েই ভারতকে পাল্টা আঘাত করতে হয় এবং পূ্র্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সাহায্য পৌঁছে দেয়।


উল্লেখ্য, সেই যুদ্ধের ফলাফল ভারতের অনুকূলেই গিয়েছিল। পাকিস্তান দু টুকরো হয়ে জন্মগ্রহণ করে বাংলাদেশ।

প্রাক্তন এই মার্কিন কূটনীতিক বলেছেন, পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চিনের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল ওয়াশিংটন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সংক্রান্ত সংকটের সূত্রপাত হয় ১৯৭১-এর মার্চে। এই সময় গোপনভাবে চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক আদানপ্রদান চলছিল। পাকিস্তানের মাধ্যমে এই আদানপ্রদান হচ্ছিল।মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ইসলামাবাদই বেজিং ও ওয়াশিংটনের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। সেই কূটনৈতিক উদ্যোগ তখন সাফল্য পাওয়ার মুখে। সেই সময় বাংলাদেশে মুক্তির জন্য সংগ্রাম জোরদার হয়। এই সংগ্রাম দমনের জন্য চরম হিংসা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথ পাকিস্তান বেছে নেয় বলে জানিয়েছেন কিসিঞ্জার। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের এই হিংসা ও দমনপীড়নের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলে চিনের সঙ্গে আলোচনার পাকিস্তানি চ্যানেলটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারত। তত্কালীন নিক্সন প্রশাসন চিনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

কিসিঞ্জার বলেছেন, কিন্তু মার্কিন কূটনীতিকরা বাংলাদেশ ট্রাজেডির দিকে নজর রাখছিলেন। তাঁরা পাক বাহিনীর অত্যাচারের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা খুবই মর্মন্তুদ ও পীড়াদায়ক। কিন্তু সেই সময় এ বিষয়ে প্রকাশ্য কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেনি ওয়াশিংটন।

কিসিঞ্জার বলেছেন, এ স্বত্ত্বেও বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের জন্য আমেরিকা প্রচুর খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ ও কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানের মাধ্যমে চিনের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠার পর আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুরের ব্যাপারে ইসলামাবাদকে অনুরোধ করে আসছিল। তত্কালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জার বলেছেন, ১৯৭১-র নভেম্বরে পাক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিতে রাজি হন।

কিসিঞ্জার এরপরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কার্যত বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, একমাসের মধ্যে প্রতিশ্রুতি ভেঙে 'অপারেশন চেঙ্গিজ খাঁ' শুরু করে পাকিস্তান ভারতের বায়ুসেনা ঘাঁটিগুলিতে বোমাবর্ষণ শুরু করে। পাল্টা আঘাত করে ভারতও। পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ায় নয়াদিল্লি।

কিসিঞ্জার বলেছেন, ডিসেম্বরে ভারত তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সামরিক বিষয় সহ চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং শরনার্থী সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পেতে পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান শুরু করে। কিসিঞ্জার বলেছেন, ওই সময় আমেরিকাকে সোভিয়েত চাপ, ভারতের উদ্দেশ্য, চিনের সন্দেহ এবং পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদের মতো বিষয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।

কিসিঞ্জার আরও বলেছেন, সমস্যার সূত্রপাতের এক বছরের মধ্যেই ১৯৭২-এর মার্চে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ভারত-পাক যুদ্ধ থেমে যায়। চিনের সঙ্গে অভিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয় আমেরিকা।