কলকাতা: অতিমারি দরজায় কড়া নাড়তেই ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। তাই বিগত তিন বছরে সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতার নতুন নিত্য-নতুন সংজ্ঞা লেখা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে অতিমারির সঙ্গে যোগ হয়ে গিয়েছে আরও একটি যুদ্ধ, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতির ভাঙাগড়া। পুরুষতন্ত্রের চোখ রাঙানির আরও একবার মধ্যযুগীয় আগল ভেঙে বেরনোর সাহস দেখিয়েছেন মেয়েরা (World Events in 2022)। অন্দরমহলের নীরব বিদ্রোহ নয়, অধিকারের দাবিতে দলে দলে রাস্তায় নেমে এসেছেন মেয়েরা। কুণ্ঠিত স্বরে অনুমতির প্রার্থনা নয়, নিজের ইচ্ছেয় বাঁচার দাবি ছড়িয়ে দিয়েছেন দুনিয়ার কাছে। তাই ইতিহাসের সন্ধি ক্ষণে দাঁড়িয়ে শুধু ঘটনাবহুল নয়, নতুন যুগের সূচনার বছর হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০২২। নতুন বছরে পদার্পণের আগে একনজরে দেখে নেওয়া যাক বিদায়ী বছরকে (Year Ender 2022)।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
শুধুমাত্র সম্পত্তি বা প্রাণহানির নিরিখে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি মাপা যায় না। যুদ্ধ ডেকে আনে মানবিক বিপর্যয়ও। রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ (Russia Ukraine War)। ভৌগলিক ভাবে পাশাপাশি অবস্থান করলেও, পারস্পরিক সহাবস্থান গড়ে ওঠেনি দুই দেশের মধ্যে। তবে এতকাল যা ছিল স্পর্শকাতর বিষয়, এ বছর তার ধ্বংসাত্মক রূপ দেখে শিউড়ে ওঠে গোটা পৃথিবী। হুঁশিয়ারি, হুমকিপর্ব পেরিয়ে এ বছর সর্বশক্তি দিয়ে ইউক্রেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশিয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বর্তমানে পৃথিবীতে ভূমিহীন শরণার্থীর সংখ্যা ৩ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে, যা ২০২১-এর তুলনায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ বেশি। আয়ারল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যাও এত নয়। সিরিয়া, আফগানিস্তান। দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেনের পরিস্থিতিও এখনও অতিসঙ্কটজনক।
জলবায়ু পরিবর্তন
শীঘ্রই বিপদ ঘনিয়ে আসছে বলে বিগত চার দশকে বার বার সতর্কবার্তা এসে পৌঁছেছে (Climate Change)। খুদে স্কুল পড়ুয়ারাও বিপদ টেরে পেয়ে রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের উদাসীনতা যে পৃথিবীকে ঘোর সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা এ বছরই সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছে। চিরাচরিত ঋতুবৈচিত্রের বদলে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে দীর্ঘমেয়াদি গ্রীষ্ম, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা জায়গা করে নিয়েছে। এ বছর তীব্র দাবদাহ অনুভূত হয়েছে ইউরোপ জুড়ে। তাপপ্রবাহে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। সবুজ পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে, শুকিয়ে গিয়েছে নদী-নালা। তীব্র তাপপ্রবাহের পর আচমকা বন্যায়কার্যত ভেসে গিয়েছে পাকিস্তান। আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ জর্জরিত হয়েছে খরায়। লেক মিডের সঙ্কোচন ঘটেছে, ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে শস্যক্ষেত। ফ্লোরিডা তছনছ করে দিয়েছে হারিকেন ইয়ান। তাতে অগাস্ট মাসে একরকম বাধ্য হয়েই আইন এনে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন রুখতে উদ্যত হয়েছে আমেরিকা। মিশরের জলবায়ু সম্মেলনে পরিবেশের ক্ষতিসাধনে বড় দেশগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব জমা পড়েছে। আনুষ্ঠানিক সিলমোহর পড়া যদিও বাকি।
লঙ্কাকাণ্ড শ্রীলঙ্কায়
ছবির মতো সাজানো দেশ। কিন্তু গোটাটাই ছিল উপর উপর (Sri Lanka Crisis)। ভিতরে ভিতরে অশান্তির স্ফূলিঙ্গ জ্বলছিল বিগত কয়েক বছর ধরেই।২০১৯ সালে জঙ্গি হামলার পর থেকেই দেশের অর্থনীতির নড়বড়ে অবস্থা প্রকট হয়ে ওঠে। তাতে শেষ পেরেক পুঁতে দেয় অতিমারি। কিন্তু এ বছর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কটে কার্যত ভারত মহাসাগরের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয় শ্রীলঙ্কা। সরকারি ভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কায় দেখা দেয় তীব্র মুদ্রাস্ফীতি। সামান্য চাল-ডালের দাম কেজিতে ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ৪০০ টাকা কেজি দরে আলু, ৩০০ টাকা কেজি দরে চিনি, ৯০০ টাকা কেজি দরে নারকেল তেল কেনার সামর্থ্য এবং সাহস, দুই-ই হারান দেশের নাগরিক। দানাপানির জোগান বন্ধ হলে ক্ষোভ গিয়ে পড়ে সরকারের উপর। সরকারি স্বেচ্ছাচারিতা, উদাসীনতা এবং স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে গোটা দেশ। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে জনসমুদ্র আছড়ে পড়ে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় নেতা-মন্ত্রীদের প্রাসাদোপম ঘরবাড়ি। রাস্তা থেকে জনসমুদ্র হটলেও, এখনও ভাঁড়ার শূন্য শ্রীলঙ্কার। ধারদেনা করে আপাতত সঙ্কট কাটানোর চেষ্টা চলছে।
গণ আন্দোলন ইরানে
মাথার হিজাব নাকি ঠিক করে বাঁধেননি ২২ বছরের মেহসা আমিনি! তাই নীতিপুলিশ শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তাঁকে (Iran Anti Hijab Protests)। দাদার সামনে থেকে মেহসাকে গাড়ি থেকে তুলে নীতিশিক্ষা দিতে নিয়ে যায় তারা। কিন্তু তার পর আর ফেরেননি মেহসা। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃতদেহ পায় পরিবার। আকছার এমন ঘটনায় বিগত কয়েক দশকে অভ্যস্তই হয়ে উঠেছিলেন ইরানবাসী। কিন্তু নির্মম অত্যাচার চালিয়ে মেহসাকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ এসে পৌঁছলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। শিশু থেকে বৃদ্ধা, মেয়েরা তো পথে নামেনই, পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সমর্থন জানান পুরুষরাও। মধ্যযুগীয় রীতিনীতির জন্যই এমনিতেই কুখ্যাতি থাকায় আন্দোলন দমনে কোনও খামতি রাখেনি দেশের সরকারি পুলিশ। সেনা নামিয়ে গুলি চালানো থেকে ব্যাপক ধরপাকড় এমনকি আন্দোলনকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান পর্যন্ত দেওয়া হয়। কিন্তু থামানো য়ায়নি আন্দোলন। বরং যত সময় গিয়েছে ততই ধার বেড়েছে তার। প্রকাশ্যে হিজাপ পোড়ানো থেকে মাথার চুল কেটে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ইরানের মেয়েরা। তার প্রভাবও অনুভূত হচ্ছে। এক দিকে, নীতি পুলিশের অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। একই সঙ্গে হিজাব বাধ্যতামূলক না রাখা নিয়েও শুরু হয়েছে আলোচনা।
চিন-আমেরিকা সংঘাত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে নতুন করে রণক্ষেত্র তৈরি না হলেও, প্রায় তার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল খাতায়-কলমে বিশ্বের প্রথম এবং দ্বিতীয় সর্বশক্তিধর রাষ্ট্র বলে গন্য চিন এবং আমেরিকা (US China Conflict)। অতিমারি থেকে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে এমনিতেই টানাপোড়েন চলছিল। উত্তাপ বাড়ে তাইওয়ান নিয়েও। তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করা চিন, আমেরিকার সরকারি প্রতিনিধিদের সেখানে পৌঁছনো ভাল বাবে নেয়নি। তাতেই সংঘাত সামনা-সামনি যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে। তাইওয়ানের আশেপাশে ঘুরতে শুরু করে চিনা যুদ্ধবিমান থেকে নৌবহর। তার মোকাবিলা করতে তাইওয়ানের পাশে থেকে আমেরিকাও সামরিক সাহায্য পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করে। যুদ্ধ যদিও এড়ানো সম্ভব হয়েছে আপাতত, তবে এই ঘটনা আগামী দিনে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে চলেছে বলে আশঙ্কিত কূটনৈতিক মহল।
টলোমলো ব্রিটেন এবং রানির মৃত্যু
এক বছরে তিন-তিন জন প্রধানমন্ত্রী। একদা মহাশক্তিধর ব্রিটেনে এমন রাজনৈতিক সঙ্কট আগে কখনও দেখা যায়নি। ব্রেক্সিট ঘোষণার পর বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির জেরে অর্থনৈতকি সঙ্কট ক্রমশ প্রকট হতে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট। জুলাই মাসে সঙ্কট চরমে উঠলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা করেন বরিস জনসন। সেপ্টেম্বরে ক্ষমতায় বসেন লিজ ট্রাস। ৫০ দিনের মাথায় সঙ্কট স্বীকার করে বিদায় নেন। ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্পমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী তিনিই। এর পর ২৫ অক্টোবর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনক। এর মধ্যেই ৮ সেপ্টেম্বর মারা যান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। প্রশাসনিক প্রধান না হলেও, ঐতিহ্য বজায় রেখে ব্রিটেনের অভিভাবক স্বরূপ দীর্ঘ ৭০ বছর কাটিয়েছেন। রাজ পরিবারের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি শাসকই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি মহিলা শাসকও ছিলেন। প্রশাসনিক ক্ষমতা না থাকলেও, প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রিসভা সব বিষয়েই তাঁকে রিপোর্ট দিতেন (Queen Elizabeth 2)। ছেলে চার্লস সিংহাসনে বসলেও, রানি না থাকায় কার্যতই অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছেন ব্রিটেনের নাগরিকরা (Britain Political Unrest)।
লাতিন আমেরিকায় লাল দুর্গ
মাত্র পাঁচ বছরে বিরাট পরিবর্তন। ২০১৭ পর্যন্তও কামান সামলাচ্ছিলেন চরম দক্ষিণপন্থী থেকে মধ্যপন্থীরা। কিন্তু ২০১৮-য় লোপেজ ওবরেদর মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু, চিলি, হন্ডুরাস, কলম্বিয়া, মতো দেশে পর পর বামপন্থী শাসন কায়েম হয়। এ বছর তাতে নাম জুড়েছে ব্রাজিলেরও। জইর বলসোনারোকে হারিয়ে এ বছর ফের এক বার সে দেশেরে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন বামপন্থী লুলা দা সিলভা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই মুহূর্তে একাধিক দেশে যেখানে দক্ষিণপন্থী এবং মধ্যপন্থী রাজনীতিকদের শাসন কায়েম, মেরুকরণের রাজনীতির রূপ যেখানে প্রকট, সেইসময় লাতিন আমেরিকার এমন রং বদল নজর কেড়েছে (Lula da Silva)।