হায়দরাবাদ: মহারাষ্ট্রে ঔরঙ্গজেবের সমাধি রক্ষা করতে এবার সরাসরি রাষ্ট্রপুঞ্জে চিঠি গেল। রাষ্ট্রপুঞ্জকে চিঠি দিলেন ইয়াকুব হাবিবউদ্দিন টুচি, যিনি নিজেকে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বংশধর বলে দাবি করেছেন। মহারাষ্ট্রের সম্ভাজিনগরে ঔরঙ্গজেবের সমাধি ঘিরে সম্প্রতি তেতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নাগপুর। উস্কানিমূলক মন্তব্য থেকে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, কিছুই বাদ যায়নি। সেই আবহেই ঔরঙ্গজেবের সমাধিটি রক্ষার জন্য সরাসরি রাষ্ট্রপুঞ্জে গেলেন হাবিবউদ্দিন। (Aurangzeb Tomb Row)
মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি সম্ভাজীনগর জেলার খুলদাবাদে ঔরঙ্গজেবের সমাধিটি রয়েছে। ঔরঙ্গজেবের নামানুসারে আগে ওই জায়গার নামও ছিল ঔরঙ্গাবাদ। পরে সেই নাম পরিবর্তন করে ছত্রপতি সম্ভাজীনগর করা হয়। ঔরঙ্গজেবের সমাধি যেখানে রয়েছে, সেই ওয়াকফ সম্পত্তির কেয়ারটেকার হিসেবে নিজের পরিচয় নিয়েছেন প্রিন্স ইয়াকুব। জানিয়েছেন, ১৯৫৮ সালের প্রাচীন সৌধ ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল আইনের আওতায় ঔরঙ্গজেবের সমাধির ‘জাতীয় গুরুত্ব’ রয়েছে। সেখানে বেআইনি নির্মাণ, নির্মাণ ভাঙা বা খোঁড়াখুঁড়ি করা যায় না। (United Nations)
রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিবকে লেখা চিঠিতে সরাসরি ঔরঙ্গজেবের সমাধির জন্য নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েনের আর্জি জানিয়েছেন প্রিন্স ইয়াকুব। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘সিনেমা, সংবাদমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমমে ইতিহাস বিকৃতির জেরে মানুষের আবেগ নিয়ে ছেলেখেলা করা সহজ হয়ে গিয়েছে। ঘৃণার প্রচার হচ্ছে, অযৌক্তিক প্রতিবাদ হচ্ছে, কুশপুতুল জ্বালিয়য়ে আগ্রাসন দেখানো হচ্ছে’। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং সংরক্ষণ প্রয়োজন বলে আন্তর্জাতিক আইনেও উল্লেখ রয়েছে, সেকথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রিন্স ইয়াকুব।
প্রিন্স ইয়াকুব জানিয়েছেন, ১৯৭২ সালে UNESCO কনভেনশনে World Cultural and Natural Heritage চুক্তিতে সই করে ভারত। সেই নিরিখে ঐতিহাসিক কোননও সৌধ যদি ধ্বংস করা হয়, অবহেলা দেখানো হয় বা বেআইনি ভাবে সৌধ পাল্টে দেওয়া হয়স তা আন্তর্জাতিক বিধিনিয়মেরও পরিপন্থী। তাই অবিলম্বে বিষয়টি পর্যালোচনা করে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার এবং ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগকে যাতে সেই মতো নির্দেশ দেওয়া হয়, ঔরঙ্গজেবের সমাধি যাতে আইনি সুরক্ষা পায়, আন্তর্জাতিক আইন মেনে যাতে সেটি সংরক্ষণ করা হয়, সেই মতো রাষ্ট্রপুঞ্জকে নির্দেশ দিতে আর্জি জানিয়েছেন প্রিন্স ইয়াকুব।
১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেব মারা যান। তাঁর ইচ্ছেকে স্বীকৃতি দিয়েই খুলদাবাদে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদেই কেন সমাধিস্থ হতে চেয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব, তার নেপথ্যেও রয়েছে কাহিনি। জানা যায়, শেখ জৈনুদ্দিন ঔরঙ্গজেবের আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন। তাঁর দরগার কাছেই সমাধিস্থ হতে চেয়েছিলেম মুঘল সম্রাট। অন্য মুঘল সম্রাটদের মতো রাজকীয় সমাধি চাননি ঔরঙ্গজেব। বরং সাধারণ মানুষের মতো সমাধি চেয়েছিলেন তিনি। সেই মতো তাঁর দেহ মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ইংরেজ সরকারের ভাইসরয় লর্ড কার্জন তাঁর সমাধিক্ষেত্রটি শ্বেতপাথরে বাঁধিয়ে দেন।
কিন্তু ঔরঙ্গজেবের সেই সমাধি ভেঙে ফেলার দাবিতে গত ১৭ মার্চ তেতে ওঠে নাগপুর। ব্যাপক হিংসা ছড়ায়, অগ্নিসংযোগ, পাথরবৃষ্টি চলে, পোড়ানো হয় কুশপুতুলও। আর এই হিংসার সূচনা ঘটে বলিউড ছবি ‘ছাওয়া’-কে ঘিরে। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর বজরঙ্গ দল দাবি করে, মারাঠা শাসকদের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের সংঘাতের যে ইতিহাস, তাতে মুঘল সম্রাটের সমাধি যন্ত্রণা এবং দাসত্বের স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে। শিবাজিপুত্র ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজের মৃত্যু, কাশী, মথুরা এবং সোমনাথে মন্দির ভাঙায় ঔরঙ্গজেবের যে ভূমিকা, সেকথা স্মরণ করে ঔরঙ্গজেবের সমাধি রাখা যায় না বলে দাবি করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদও। মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়ণবীসের কাছে আগে স্মারকলিপিও জমা দেওয়া হয়। বলা হয়, ছত্রপতি সম্ভাজীনগরে ঔরঙ্গজেবের যে সমাধি রয়েছে, তা না সরানো হলে ওই নির্মাণটির পরিণতিও হবে বাবরি মসজিদের মতোই। মিছিলও বের হয় মুম্বইয়ে।
এসবের মধ্যে খোদ ফড়ণবীস বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তাঁকে বলতে শোনা যায়, “যে হারে নির্বিচারে হত্যা চালিয়ে গিয়েছেন ঔরঙ্গজেব, তার পরও তাঁর সমাধি রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে সরকারকে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমি কথা দিচ্ছি, মহিমাকীর্তন করে কেউ যদি ঔরঙ্গজেবকে গরিমান্বিত করতে চান, তিনি সফল হবেন না।" সাতারার বিজেপি সাংসদ উদয়নরাজে ভোঁসলে, যিনি ছত্রপতি শিবাজির বংশধর, তিনি ঔরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবি তুললে দেবেন্দ্র জবাবী চিঠিতে লেখেন, 'আমরাও একই জিনিস চাই। কিন্তু আইনের এক্তিয়ারের মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে। ওইটি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত একটি সৌধ। কংগ্রেস সরকারের আমলে সেটিকে সংরক্ষিত সৌধের স্বীকৃতি দেওয়া হয়'।
এমন পরিস্থিতিতে মুখ খোলেন বিরোধীরাও। 'ছাওয়ার' মতো ছবি ঔরঙ্গজেবকে অত্যাচারী শাসক হিসেবে দেখালেও, তিনি তেমনটা মনে করেন না বলে মন্তব্য করেন সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক আবু আজমি। মহারাষ্ট্রের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হর্ষবর্ধন সপকল আবার মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়ণবীসের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের তুলনা টানেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, "ঔরঙ্গজেব অত্যাচারী শাসক ছিলেন। আজ দেবেন্দ্র ফড়ণবীসও সমান অত্যাচারী।" সেই নিয়ে ক্রমশ তেতে ওঠে পরিস্থিতি, যা পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও হিংসার আকার ধারণ করে।