নোভেল করোনাভাইরাস উদ্ভুত অতিমারি ব্যাতীত সাম্প্রতিক কালে এমন অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়নি পৃথিবী। যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সাক্ষী হতে হয়েছে বছরভর। রাশিয়া বনাম ইউক্রেন এবং ইজরায়েল বনাম প্যালেস্তাইনের হামাস যুদ্ধ আগে থেকেই চলছিল। এ বছরও তাতে বিরাম পড়েনি। বরং যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে কোথাও, কোথাও আবার যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। কোথাও কূটনৈতিক সংঘাত চলছে, কোথাও আবার গণ অভ্যুত্থানে সরকার পড়ে গিয়েছে। যুদ্ধ, সংঘাতের নিরিখে ২০২৪ তাই ঘটনাবহুল বছর হয়ে রইল। (Year Ender 2024)


২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে ৪ থেকে ৭ লক্ষ রুশ সেনার মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তাঁদের প্রায় ৪৩ হাজার সেনা মারা গিয়েছেন বলে জানান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ইউক্রেনে প্রায় ১২ হাজার নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলেও পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। 
গাজায় এখনও পর্যন্ত ৪৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২১ লক্ষ মানুষ আটকে রয়েছেন জতুগৃহে। সেই আবহে লেবাননেও হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। দফায় দফায় বিস্ফোরণ এবং নাগাড়ে হামলায় প্রায় ৪ হাজার মানুষের প্রাণ গিয়েছে। (Wars and Conflicts in 2024)




পাশাপাশি ইয়েমেনেও রকেট বর্ষণ করেছে ইজরায়েল। পাশাপাশি, পশ্চিম এশিয়ার অন্যত্র তো বটেই, ভারতের পড়শি দেশ বাংলাদেশও অশান্ত হয়ে উঠেছে। যুদ্ধের মেঘ ঘনাচ্ছে ইউরোপেও। নতুন বছরে পদার্পণ করার আগে দেখে নেওয়া যাক, পৃথিবীর কোথায় কোথায় এই মুহূর্তে যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধের সম্ভাবনা মাথাচাড়া দিচ্ছে, গৃহযুদ্ধ-সংঘর্ষে টালমাটাল কোন দেশগুলি। (Wars and Conflicts in 2024)




—ফাইল চিত্র।


ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ: ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে যুদ্ধ চলছে। ২০২৪ সালে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধের ফলে সঙ্কট নেমে এসেছে গোটা পশ্চিম এশিয়ার উপর। আন্তর্জাতিক মহল হস্তক্ষেপ করতে চাইলেও ঝাঁঝ কমাতে নারাজ ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। গাজায় পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, নেতানিয়াহু যুদ্ধাপরাধ ঘটাচ্ছেন বলে সরব বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। প্রশ্ন উঠছে আমেরিকার ভূমিকা নিয়েও। বরং প্যালেস্তাইনের পাশাপাশি, লেবাননেও হামলা চালানো হয়। সশস্ত্র সংগঠন হুথি— মোকাবিলায় হামলা চালানো হয় ইয়েমেনেও। আবার সিরিয়াতেও রকেট বর্ষণ করেছে ইজরায়েল। বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। 




—ফাইল চিত্র।


রাশিয়া বনাম ইউক্রেন যুদ্ধ: ২০২২ সাল থেকে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। প্রায় তিন বছর কেটে গেলেও, এখনও পর্যন্ত সমঝোতা হয়নি। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দুই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া। এর ফলে ইউরোপ জুড়ে শরণার্থী সঙ্কটও দেখা দিয়েছে।




—ফাইল চিত্র।


ইরান বনাম ইজরায়েল সংঘাত: অক্টোবর মাসে সঙ্কট আরও ঘোরাল হয়। হামাস এবং ইরান সমর্থিত হেজবোল্লা নেতা হাসান নাসরাল্লা এবং ব্রিগেডিয়ার আব্বাস নিলফরুশানের মৃত্যুর বদলা নিতে ১ অক্টোবর ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট ছোড়ে ইরান। ১৮০-র বেশি রকেট ছোড়া হয়। এর পর অক্টোবরের শেষ দিকে ইরানকে লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু রকেট ছোড়ে ইজরায়েল। ইরানের সেনা শিবিরগুলিতে হামলা চালায় তারা। এমনিতেই বহু বছর ধরে ইরান এবং ইজরায়েলের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ চলে আসছিল। এবছর সেই সংঘাত যুদ্ধের আকার ধারণ করার উপক্রম হয়। ইজরায়েলর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে না ইরান। ইজরায়েলকে 'ক্যান্সারের টিউমার' বলেও উল্লেখ করেন ইরানের সর্বোচ্চ শাসক আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। কিন্তু ইজরায়েলকে এবার সমর্থন করে আমেরিকা। 




—ফাইল চিত্র।


সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, আসাদ সরকারের পতন: গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। নভেম্বর মাসে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন শক্তি বাডি়য়ে এগোতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরে দামাস্কাস দখল করে। রাশিয়া এবং ইরানের সহযোগিতায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া। শরণার্থী সঙ্কট দেখা দিয়েছে তুরস্ক, লেবাননে। পাশাপাশি, সিরিয়ায় ইসলামি চরমপন্থী শাসন কায়েম হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।




—ফাইল চিত্র।


সুদানের গৃহযুদ্ধ: ২০২৩ সালে সূচনা ঘটলেও, ২০২৪ সালে সুদানের গৃহযুদ্ধ চরমে পৌঁছয়। সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত যুদ্ধের আকার ধারণ করেছে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, ধ্বংস হয়ে গিয়েছে পরিকাঠামো। সবমিলিয়ে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন সেখানে। আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ মধ্যস্থতার চেষ্টা করলেও, শআন্তি ফেরেনি। এই মুহূর্তে খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছে সেখানে। দলে দলে শরণার্থীরা প্রবেশ করছেন মিশর এবং ইথিওপিয়ায়। 




—ফাইল চিত্র।


মায়ানমার গৃহযুদ্ধ: ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের থেকেই ভারতের পড়শি দেশ মায়ানমারের পরিস্থিতিতি টালমাটাল। আঙ সান সুচি-কে উৎখাত করে সেখানে ক্ষমতা দখল করে জুন্টা। সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ সালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন পিপলস ডিফেন্স ফোর্স জুন্টাকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর। গণতন্ত্রের সমর্থক বলে নিজেদের পরিচয় দেয় ওই সংগঠন। ডিসেম্বর মাসে মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ নেমে এসেছে। ভূরি ভূরি মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বহির্ভূত ভাবে হত্যার ঘটনা সামনে আসছে। সেই নিয়ে সতর্কও করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। জুন্টা নেতাদের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর দাবি উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে মায়ানমার থেকে দলে দলে মানুষজন তাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন।




—ফাইল চিত্র।


ইয়েমেন বনাম ইজরায়েল সংঘাত: প্যালেস্তাইনের হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধ চলাকালীন, প্যালেস্তাইনের পক্ষ নেয় ইয়েমেনের বিদ্রোহী সংগঠন হুথি। লোহিত সাগরে ইজরায়েলি জাহাজ, পরিকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালায় তারা। হুথিদের ইরান সহযোগিতা জোগাচ্ছে বলে অভিযোগ। এমন পরিস্থিতিতে ইয়েমেনে রকেট ছুড়েছে ইজরায়েল, তাতে অনেকে জন মারাও গিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে ফাঁপরে পড়েছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। ইজরায়েল এবং হুথি, দুই পক্ষের সঙ্গেই বরাবরের সুসম্পর্ক তাদের। ফলে পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও নড়বড়ে হয়ে উঠছে। 




—ফাইল চিত্র।


বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থান এবং টালমাটাল পরিস্থিতি: সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন চলছিল কয়েক মাস ধরেই। কিন্তু অগাস্ট মাসে আচমকাই আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানে পাল্টে যায়। অশান্ত হয়ে ওঠে ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ। ঢাকার রাস্তা কার্যতই রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। গুলি, বোমা, খুন কিছুই বাদ যায়নি। প্রায় ৫০০ জনের মৃত্যু হয় বলে খবর আসে। এমন পরিস্থিতিতে গত ৫ অগাস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে আসেন। এর পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু তার পরও শান্তি ফেরেনি বাংলাদেশে। বরং সংখ্যালঘু হিন্দু এবং খ্রিস্টানদের উপর লাগাতার হামলা, অত্যাচারের ঘটনা সামনে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেরই অবনতি হয়নি শুধু, বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেআইনি অনুপ্রবেশও বাড়ছে। পাশাপাশি, পাকিস্তান এবং চিনের সঙ্গে যেভাবে সখ্য বাড়ছে বাংলাদেশের, তাতে উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক সমীকরণেও রদবদল ঘটবে বলে আশঙ্কা। 





—ফাইল চিত্র।


ইউরোপে যুদ্ধের আশঙ্কা: যুদ্ধের আশঙ্কা মাথাচাড়া দিচ্ছে ইউরোপেও। নাগরিকদের ইতিমধ্যেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিয়েছে সুইডেন সরকার। সেই মতো পুস্তিকা বিলি করা হচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়। অন্য দিকে, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে অনলাইন মাধ্যমে নির্দেশিকা জারি করেছে ফিনল্যান্ডও। গোটা পৃথিবীতে যুদ্ধ, সংঘাতের আবহেও দশকের পর দশক নিরপেক্ষ অবস্থানেই কায়েম থেকেছে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই দুই দেশ NATO-তে যোগ দেয়। ডেনমার্কেও প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন সরকার। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জল, খাবার, ওষুধের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি, নিরাপদ থাকার উপায় সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করা হয়।