কলকাতা: একেবারে ভোর। চারিদিক শুনশান। সেই সময় রাস্তার পাশে কোনও এক জায়গা থেকে ক্রমাগত এক শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। রাস্তায় তখন একেবারে কম লোকজন। তার মধ্যেই গুটিকয়েকের কানে আসে কান্নার আওয়াজ। কৌতূহলের জন্যই হাতে টর্চ নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। কান্নার উৎস চোখে পড়তেই চমকে উঠেছিলেন তাঁরা। একটা তোয়ালেতে জড়ানো এক শিশু পড়ে রয়েছে রাস্তার পাশে। গায়ে ততক্ষণে পিঁপড়ে দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে তুলে আনেন তাঁরা। সোজা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন দেখা যায় ওই শিশুকন্যার দুই পা নেই। ডাক্তাররা দেখে বুঝতে পারেন পা ছাড়াই জন্মেছে ওই শিশুকন্যা। তখন ওই শিশুর বয়স মেরেকেটে কয়েক সপ্তাহ বয়স। বাবা-মায়ের কোল ছেড়ে রাস্তায় জায়গা হয়েছে তখনই।  


যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, সেটি ঘটেছিল তাইল্যান্ডের পাক চোং (Pak Chong) নামে একটি জায়গায়। তখন নব্বইয়ের দশকের একেবারে প্রথম দিক। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী সেখানে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে রাস্তায় কেউ বা কারা ফেলে গিয়েছিল ওই শিশুকে। তারিখটা ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর। হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিল ওই শিশু। খোঁজ চলেছিল বাবা-মায়ের, কিন্তু সব ব্যর্থ হয়। প্রকৃত বাবা-মা কে তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত সেদেশের ফস্টার হোমে স্থান হয়। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী এক বয়স্ক দম্পতির কাছে ছোটবেলা কেটেছে। তারপর হঠাৎ ভাগ্যের আকাশে সূর্য ওঠে। যখন বছর পাঁচেক বয়স, তখন আমেরিকার এক মহিলা ওই শিশুকে দত্তক নেন। তাইল্যান্ড থেকে সোজা আমেরিকায় আসে সে। ততদিনে তার একটা পরিচয় হয়েছে-- নাম কানিয়া সেসার (Kanya Sesser)। তখনও কেউ জানে না বিশেষভাবে সক্ষম এই কন্যা আর বছর দশেক পর থেকেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাবে।


শূন্য থেকে উড়ান:
এখন কানিয়া সেসারের বয়স বছর তিরিশ। একাধারে স্কেটবোর্ডার, মডেল এবং অ্যাক্টিভিস্ট কানিয়া। প্যারা অ্যাথলেট হিসেবেও পরিচিত। মোনো-স্কি থেকে শুরু করে হুইলচেয়ার রেসিংও করেন তিনি। মডেল হিসেবেও বেশ পরিচিত। কিন্তু এই সাফল্য-লাইমলাইট একদিনে আসেনি। রাস্তাটাও সহজ ছিল না। পাঁচ বছর বয়সে আমেরিকার একটি পরিবার কানিয়াকে দত্তক নেয়। ওই বয়সে হঠাৎ করে চেনা জগত ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য দেশে চলে আসা যথেষ্ট ধাক্কার। ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা। এতদিন ধরে চেনা লোকগুলিকে হঠাৎ করে আর দেখতে না পাওয়া- এই বিষয়টও যথেষ্ট যন্ত্রণার। প্রবল সমস্যা হয়েছিল ইংরেজি শেখা নিয়েও।


পড়াশোনা-খেলাধুলো-লড়াই:
আমেরিকায় এসে প্রথমেই বেশ কিছু অস্ত্রোপচার হয়েছিল। কারণ কানিয়ার হাতের আঙুলের গঠনেও সমস্যা ছিল। একটি হাতের আঙুল জোড়া ছিল। অন্য হাতে একটি অতিরিক্ত আঙুল ছিল। একাধিক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা সারানো হয়। এই সময়েই অ্যাডাপ্টিভ স্পোর্টসের সঙ্গে কানিয়ার পরিচয়। এই পরিচয়ই জীবনের মোড় ঘোরায়। হুইলচেয়ারে বসে দৌড়, হুইলচেয়ার বাস্কেটবল শুরু করে কানিয়া সেসার। তার সঙ্গে যোগ দেয় স্কেটবোর্ডিং। বছর কয়েক আগের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন, ছোটবেলায় তাঁর পাড়ায় সমবয়সীরা স্কেটবোর্ড চড়ে এদিক-ওদিক ঘুরত। তাদের দেখেই স্কেটবোর্ডিংয়ের ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর। সেটাই এখন ভরসা হয়ে গিয়েছে, এখন অনেক সময়েই কানিয়া হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন না। অধিকাংশ সময়েই যাতায়াতে তাঁর সঙ্গী স্কেটবোর্ড। একদিকে যখন খেলাধুলোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটছে, ঠিক তখনই তাঁর লড়াই চলছিল ইংরেজির সঙ্গে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন, প্রথমদিকে ইংরেজির ব্যাকরণ বুঝতে পারতেন না। স্কুলের পঠনপাঠনও তাঁর কাছে অত্যন্ত কঠিন লাগত। প্রায় ৯ বছর বয়সে ধীরে ধীরে ইংরেজি রপ্ত হওয়া শুরু হয়। ততদিনে আমেরিকায় আসার পরে ৪ বছর কেটে গিয়েছে।


একদিকে চলছে পড়াশোনা, অন্যদিকে কানিয়া মজে খেলাধুলোয়। দীর্ঘদিন ধরে হুইলচেয়ার রেস করেছিলেন। স্কুলজীবনে National Junior Disability Challenge-এর সোনা জেতেন তিনি। জাতীয় স্তরে ব্রোঞ্জও জিতেছেন। তবে তাঁর মূল ধ্যানজ্ঞান স্কেটবোর্ডিং। স্নো-বোর্ডিংও করেছেন তিনি। তার জন্য এখনও চলছে নিরন্তর সাধনা।


গ্ল্যামার দুনিয়ায় পা:
শুধুই ক্রীড়জগত নয়। গ্যামার দুনিয়াতেও সাবলীল কানিয়া সেসার। হাইস্কুলে থাকতে ১৬-১৭ বছর বয়সে প্রথম মডেলিংয়ের সুযোগ আসে। একাদিক স্পোর্টস ওয়্যার সংস্থার হয়ে মডেলিং করেছেন। ২০২১ ও ২০২২ সালে নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইকের রানওয়েতেও মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, মডেল হিসেবে কখনও নিজেকে কারও থেকে পিছিয়ে পড়া মনে হয়নি। তিনি নিজে যা, সেভাবেই ক্যামেরার সামনে স্বাচ্ছন্দ্য তিনি।
বেশ কিছু সিনেমাতেও কাজ করেছেন কানিয়া। কাজ করেছেন টিভি সিরিজে। The Walking Dead, Fear of the walking Dead- সিনেমায় জম্বির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। ২০২২ সালের শেষে মুক্তি পাওয়া Babylon-এও অভিনয় করেছেন কানিয়া।


গ্ল্যামার দুনিয়ায় তো সৌন্দর্যের বেঁধে দেওয়া সংজ্ঞা থাকে। সৌন্দর্য আসলে কী? একটি সাক্ষাৎকারে কানিয়া বলছেন, 'শুধু শারীরিক সৌন্দর্য নয়, মনের সৌন্দর্যও প্রয়োজনীয়। স্বাভাবিকত্ব কি? কেউ স্বাভাবিক নয়, সবাই নিজের নিজের মতো করে আলাদা।' নিজেকে চিনতে শেখার বার্তা দিচ্ছেন তিনি। মন কী বলছে, কী করতে নিজের সবচেয়ে ভাল লাগে, পথ দেখাবে সেটাই। তবে আসল বিষয় নিজের উপর ভরসা আর অদম্য জেদ। তার জেরেই স্বপ্ন দেখেন কানিয়া সেসার। আর স্বপ্ন দেখতে শেখান সবাইকে।


আরও পড়ুন: রঙের উৎসবে সামরিক শক্তি প্রদর্শন, 'হোলা মহল্লা'-য় অতীত লড়াইকে সম্মান পঞ্জাবে