কলকাতা: সেদিনটাও শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই। তবে বিশেষত্ব ছিল আলাদা। কারণ স্বপ্নের একটি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সেদিনই যে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন বয়ে এনেছিল তা জানত না কেউই। এক লহমায় ভেঙেচুড়ে গিয়েছিল যাবতীয় আশা-আকাঙ্খা। কিন্তু যোদ্ধা তো কখনও হার মানেন না। ইনিও হেরে যাননি। সব প্রতিকূলতার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়েছিলেন। সেই লড়াইয়ের গল্পটা রূপকথার ফিনিক্সের থেকে কোনও অংশে কম নয়।
যাঁকে নিয়ে এই কথাগুলো লেখা হল। তাঁর নাম অরুণিমা সিনহা (Arunima Sinha)। প্রথম মহিলা Amputee হিসেবে এভারেস্ট জয়ের (first female amputee to scale Mount Everest) কৃতিত্ব রয়েছে তাঁর। কিন্তু আকাশ ছোঁয়ার যে সাফল্য তিনি পেয়েছেন তার পিছনে রয়েছে বহু কষ্ট-বহু ত্যাগের কাহিনি।
সেই কালো দিন:
২০১১ সাল। অরুণিমার বয়স তখন ২৪ এর আশপাশে। ততদিনে ক্রীড়াজগতে পরিচিত মুখ তিনি। জাতীয় স্তরের ভলিবল খেলোয়াড় (Volleyball Player) হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তারসঙ্গেই চলছে চাকরির প্রস্তুতি। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর চাকরির পরীক্ষা দিতে ট্রেনে করে লখনউ থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন তিনি। সেই সময়েই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। কিছু ছিনতাইবাজ-দুষ্কৃতীর হামলার শিকার হন তিনি। তাঁর গলার সোনার চেন ছিনিয়ে নিতে ছেয়েছিল ওই দুষ্কৃতীরা। কিন্তু মায়ের দেওয়া সোনার চেন এভাবে হাতছাড়া করতে চাননি তিনি। বাধা দেওয়ায় তাঁকে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় দুষ্কৃতীরা। সেই সময় পাশের লাইন দিয়ে যাওয়া ট্রেনের ধাক্কায় অরুণিমার পা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। হাঁটুর নীচ থেকে বাদ যায় ১টি পা। সেই সময়ের কথা ভাবলে এখনও কেঁপে ওঠেন তিনি, একাধিক সাক্ষাৎকারেই তিনি প্রায় এরকম কথা বলেছেন।
ছোট থেকে আর বাকি পাঁচজনের মতোই খেলাধুলো, কাজকর্মে অভ্যস্ত কোনও ব্যক্তি যদি হঠাৎ এমন দুর্ঘটনার শিকার হন। তাঁর মনের অবস্থা কোন জায়গায় দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু অরুণিমা সিনহা (Arunima Sinha) অন্য ধাতুতে গড়া। হাসপাতালের চিকিৎসাধীন থাকার সময়েই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই যে করবেন তা স্থির করে নিয়েছিলেন। তার জন্য নিজেই নিজের জন্য বেঁধে নিয়েছিলেন লক্ষ্য- এভারেস্ট। অনেকেই হয়তো মনে করেছিলেন এটা অবাস্তব। যাঁর একটি পা বাদ গিয়েছে। এতবড় দুর্ঘটনার পরে মানসিকভাবে ধাক্কা লেগেছে। তিনি কীভাবে পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গকে পায়ের তলায় রাখবে? এই প্রশ্নই অনেকের মনে ছিল। আর সেই অবিশ্বাস-সন্দেহকেই নিজের জেদের জ্বালানি করেছিলেন অরুণিমা সিনহা।
একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন, মনের জোর বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পর্বত অভিযান সংক্রান্ত লেখা পড়তেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন, পর্বত অভিযানের কথা শুনে নানা জায়গা থেকে টিটকিরি শুনলেও একজন মহিলা পর্বতারোহী তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি হলেন বাচেন্দ্রী পাল (ইনি প্রথম ভারতীয় মহিলা পর্বতারোহী যিনি এভারেস্ট জয় করেছেন)। তারপর কঠোর পরিশ্রম শুরু। উত্তরকাশীর নেহরু ইন্সটিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করেন তিনি। তারপর দেড় বছরের কঠোর পরিশ্রম। নিয়মিত ব্যায়াম, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লড়াই, মানসিক শক্তি বৃদ্ধির লড়াই- কী ছিল না সেই তালিকায়। তারপর আসে সুযোগ। ২০১৩ সাল, টাটা গ্রুপের স্পনসরশিপে হয় Eco Everest Expedition. সেই অভিযানেই এভারেস্টকে পায়ের তলায় আনেন অরুণিমা সিনহা।
মায়ের কথা:
লখনউয়ে জন্ম অরুণিমার। তাঁর বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীকে। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের হাতে বড় হয়ে ওঠা। ছোট থেকেই বিভিন্ন খেলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বাবার পথে হেঁটেই নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীতেই যোগ দেওয়া স্বপ্ন ছিল তাঁর। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। এমন দুর্দিনে কাকে পাশে পেয়েছিলেন? বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে অরুণিমা এক নিঃশ্বাসে উত্তর দিয়েছিলেন- মা। পা বাদ যাওয়ার পর থেকে লড়াই, তারপর এভারেস্ট (Everest Expedition) জয়। পুরো সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত মাকে পাশে পেয়েছেন বলে সবসময়েই জানিয়েছেন অরুণিমা।
রোল মডেল কে?
যিনি নিজে রোল মডেল, তাঁরও রোল মডেল ছিল কেউ। রিপোর্টে প্রকাশিত, তিনি জানিয়েছিলেন এই লড়াইয়ের সময়টা তাঁর কাছে রোল মডেল ছিলেন ক্রিকেটার যুবরাজ সিং। প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার মাঠে যেমন ছক্কা হাঁকিয়েছেন, তেমনই ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ে, মারণরোগকে হারিয়ে ফের ফিরেছিলেন মাঠে। তাঁর লড়াই অরুণিমার কাছে মনোবল ছিল।
এভারেস্ট জয়ের পর থেমে থাকেননি তিনি। ইতিমধ্যেই একাধিক মহাদেশের শৃঙ্গ তাঁর পায়ের তলায় এসেছে। সেই তালিকায় রয়েছে আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো (Mount Kilimanjaro), ইউরোপের এলব্রুস (Mount Elbrus), দক্ষিণ আমেরিকায় অ্যাকনকাগুয়া, অস্ট্রেলিয়ার Kosciuszko. এখন বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের জন্য একটি অলাভজনক স্কুল চালান তিনি।
এমন জীবন, বইয়ের পাতা উঠে আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় অরুণিমার বই 'Born Again on the Mountain'. ২০১৫ সালের পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করা হয় এই লড়াকু মহিলা পর্বতারোহীকে।
নানা সময়ে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে জীবনে। কখনও সাফল্য, কখনও আবার হতাশার অন্ধকার। সোভিয়েত রাশিয়ার সাংবাদিক বরিস পলেভয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খবর করার সময় রেড আর্মির এক যুদ্ধবিমান চালকের সংস্পর্শে এসেছিলেন। বিমান দুর্ঘটনায় যাঁর দুটো পা বাদ গিয়েছিল। তারপর অসম্ভবকে সম্ভব করে নকল পা নিয়ে যুদ্ধবিমানের ককপিটে বসেছিলেন সেই পাইলট আলেক্সেই মেরেসিয়েভ। তাঁর জীবনের কাহিনি নিয়ে পরে বরিস পলেভয়ের কালজয়ী উপন্যাস বেরোয় - 'মানুষের মতো মানুষ'। সূদূর রাশিয়া থেকে আমাদের ভারত। আলেক্সেই থেকে অরুণিমা- প্রমাণ করেছেন মনের জোর এবং লড়াইয়ের ক্ষমতা থাকলে বারবার ফিনিক্স হয়ে ওঠা যায়। হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকা অরুণিমাদের মনে আলো জ্বেলে দেয় এই অরুণিমার কাহিনি।
আরও পড়ুন: পা নেই, তাতে কী? স্কেটবোর্ডে চেপে স্বপ্ন-উড়ান কানিয়ার