পায়েল মজুমদার, কলকাতা: প্রতীকী নয়, একেবারে নির্ভেজাল-খাঁটি অনশন। তাও টানা ৬৩ দিন। শোনা যায়, মৃত্যু সেই অনশন-ক্লিষ্ট তরুণকে 'মুক্তি'দেওয়ার আগেই দেহের একাংশে পক্ষাঘাত দেখা দেয়। নির্মম অত্যাচারে ফুসফুসও তখন বিধ্বস্ত। দেশকে স্বাধীন করার জন্য যে কোনও মূল্য দিতে রাজি ছিলেন যতীন্দ্রনাথ দাস (Jatindra Nath Das On His Birthday)। হয়েছিলও তাই। লাহৌর সেন্ট্রাল জেলে (Lahore Central Jail) ৬৩ দিনের অনশনের পর মারা যান ২৫ বছরের তরুণ। সালটা ১৯২৯। ইতিহাস যদিও বলছে, এর বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে (Indian Freedom Struggle) যোগ দিয়েছিলেন 'যতীন দাস'। আজ ভারতের এই বীর-বিপ্লবী সন্তানের জন্মদিন।
পরিচয়...
১৯০৪ সালের ২৭ অক্টোবর। কলকাতার শিকদার বাগানের বাসিন্দা বঙ্কিম বিহারী দাস এবং সুহাসিনী দেবীর কোল আলো করে এল এক পুত্রসন্তান। দম্পতির দুই পুত্রসন্তানের মধ্যে সে-ই বড়। মেধাবী ছাত্র। একই সঙ্গে নিয়মিত কুস্তি লড়ে, চুটিয়ে ফুটবলও খেলে। ছোট ভাই কিরণের সঙ্গেও ভাব তার। কিন্তু ৯ বছর বয়সে মা সুহাসিনী দেবীর প্রয়াণের পর থেকে ছোট্ট যতীন প্রায়ই বাবাকে জিজ্ঞাসা করত, মা কোথায়? বাবা বলতেন,উপরে কোথাও রয়েছেন তিনি। নিয়ত নজর রাখছেন দুই সন্তানের উপর। আশীর্বাদও করছেন। শিশুমন এই উত্তরে কতটা সান্ত্বনা পেত? ইতিহাস খোঁজ রাখেনি।
তবে ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকিদের কথা শুনতে ভালোবাসত খুদে যতীন। পরাধীন দেশ, ব্রিটিশ শাসন ও শোষণে জর্জরিত ভারতমাতার এই বীর-সন্তানদের আত্মত্যাগ তাকে ছুঁয়ে যেত শৈশব থেকেই। তার উপর সে সময়টা দেশে সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের ঝাঁঝ বাড়ছে। এক দিকে বাংলা, অন্য দিকে পঞ্জাব---কাতারে কাতারে মানুষ দেশের জন্য প্রাণ দিতে তৈরি। পঞ্জাবে গদর আন্দোলন, কর্তার সিংহের ফাঁসি, দেশবাসীর সহিষ্ণুতার সীমা অতিক্রম করতে বাধ্য করেছে।
এমন সময়ে মহাত্মা গাঁধীর আহ্বানে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয় কিশোর যতীন। ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে সবেমাত্র 'ফার্স্ট ডিভিশন'-এ পাশ করেছে সে। কিন্তু পরাধীন দেশে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে লাভ? ১৯২১ সালে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয় কিশোর। 'পিকেটিং'-এর জন্য ব্রিটিশ পুলিশ ছ'মাস তাকে আটক রাখে। এর পর যতীন্দ্রনাথের বাবা স্পষ্ট বলেন, আগে মন দিয়ে লেখাপড়া জরুরি। যতীন জানিয়ে দেন, লেখাপড়া অবশ্যই করবেন। তবে দেশের স্বাধীনতা সকলের আগে। রেগে গিয়ে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। কিশোরও থামার পাত্র নয়। সোজা দক্ষিণ কলকাতায় কংগ্রেস দফতরে পৌঁছে যায়। ব্রিটিশ-বিরোধিতা তখন তুঙ্গে। কিন্তু চৌরিচৌরার ঘটনা এবং তার পর গাঁধীজির আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল কিশোরকে।
নতুন পথে...
বাড়ি ফিরে নতুন উদ্যমে লেখাপড়ায় মন দিলেও দেশের কথা, দশের কথা ভোলেননি তিনি। বঙ্গবাসী কলেজে বি.এ. পড়ার সময় বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত হতে শুরু করেন তরুণ যতীন। দুঃস্থদের জন্য নাইট স্কুল প্রতিষ্ঠা থেকে মহামারী-বিধ্বস্ত এলাকায় ওষুধ ও ত্রাণ নিয়ে যাওয়া, সর্বত্র সকলের আগে থাকতেন এই বঙ্গতনয়। একদিকে দেশের কাজে তৈরি, অন্য দিকে ইস্পাতকঠিন ব্যক্তিত্বের তরুণকে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান সোশ্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাজকর্মের জন্য বেছে নিতে দেরি করেননি শচীন্দ্রনাথ সান্যাল। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সহকারী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের সূত্রেই HRA-তে আসা যতীনের। তরুণদের সাহায্যে সশস্ত্র আন্দোলনই ছিল এর লক্ষ্য।
সংগঠনে যোগ দিয়ে অচিরেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ দাস। সতীর্থদের বোমা বানানো, বিশেষত পার্সেল বোমা শেখাতেন তিনি। এই সময়েই একাধিক ছদ্মনাম ব্যবহার শুরু করেন। শহিদ ভগৎ সিংহের সঙ্গে পরিচয়ও এই সূত্রে। শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে 'যতীনদা'বলেই ডেকে গিয়েছিলেন পঞ্জাবের বীর বিপ্লবী।
টালমাটাল সময়...
১৯২৪ সালের ২৪ অক্টোবর। বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স নামে এক কালা কানুন এনে নির্বিচারে ধরপাকড় চালানোর ফন্দি করেছে ব্রিটিশ সরকার। এর ঠিক পরের পর' কাঁকোড়ি ষড়যন্ত্র মামলায়' রামপ্রসাদ বিসমিল-সহ একাধিক বিপ্লবীকে ফাঁসির সাজা দেয় ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থা।একই মামলায় বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স অ্যাক্টের আওতায় গ্রেফতার করা হয়েছিল যতীন্দ্রনাথ দাসকেও। প্রথমে মেদিনীপুর জেলের ৪৪ নম্বর কুঠুরিতে রাখা হয় তাঁকে। জানলা নেই, আলো নেই এমন কুঠুরিতে কার্যত মৃতপ্রায় অবস্থা হয়েছিল তাঁর। পরে আলিপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখান থেকে ফের ময়মনসিংহ জেলে পাঠানো হয় তাঁকে। আসলে, সহ-বন্দিদের নানা বিষয়ের জন্য উদ্দীপিত করতেন যতীন্দ্রনাথ দাস। সেই ভয়েই তাঁকে এক জেল থেকে অন্য জেলে পাঠাত ব্রিটিশ সরকার। একবার ব্রিটিশ শাসিত জেলের নিম্নমানের খাবার ও অত্যন্ত অভব্য আচরণের প্রতিবাদে পান্নালাল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে অনশন করেছিলেন তিনি। সে বার ২২ দিন চলে অনশন। গোয়েন্দাকর্তা তাঁদের দাবিদাওয়ার কিছুটা পূরণ করতে বাধ্য হন। এর পরের পর্বে অবশ্য আর ফেরা হয়নি তাঁর।
না ফেরার দেশে...
সাইমন কমিশনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে লাহৌরে ব্রিটিশ পুলিশের লাঠির আঘাতে জখম হন লালা লাজপত রায়। ১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। ভগৎ সিংহ, চন্দ্রশেখর আজাদ-সহ পঞ্জাবের একাধিক বিপ্লবী সিদ্ধান্ত নেন, এর জবাব দেবেন। ১৭ ডিসেম্বর লাহৌর মেন রোডের উপর পুলিশ অফিসারকে খুন করেন ভগৎ সিংহ এবং রাজগুরু। এর পরই কলকাতায় পালিয়ে আসেন তাঁরা। বোমা বানানো শিখতে চান যতীন্দ্রনাথ দাসের কাছে। রাজি হন তরুণ। পৌঁছে যান আগরায়। শুরু হয় বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল দিল্লির কনফারেন্স হল-এ ছোড়া হয় বোমা। সঙ্গে স্লোগান, 'লং লিভ রেভোলিউশন।'আত্মসমর্পণ করেন ভগৎ সিংহ, বটুকেশ্বর দত্ত। শোনা যায়, এর তদন্ত করতে গিয়ে লাহৌরে পুলিশ অফিসার খুন-সহ একাধিক মামলার তথ্য পেয়ে যায় ব্রিটিশ তদন্তকারীরা। গ্রেফতার হন আরও অনেকে। ১৯২৯ সালের ১৪ জুন কলকাতার হাজরা রোড থেকে গ্রেফতার হন যতীন্দ্রনাথ দাসও। তাঁকে লাহৌর বরস্তাল জেল-এ নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে দাগী আসামিদের সঙ্গেই রাখা হত রাজনৈতিক বন্দিদের। খাবারের মান এত খারাপ যে মুখে তোলা যায় না। পরিচ্ছন্ন জামাকাপড়, ওষুধ, তেল, সাবান, পানীয় জলটুকুও দেওয়া হত না তাঁদের। সংবাদপত্র তো দূরের কথা। অথচ পাশেই ইউরোপীয় বন্দিদের জন্য সবরকম সুযোগ সুবিধা থাকত। এই বৈষম্যের প্রতিবাদে ভগৎ সিংহ এবং বটুকেশ্বর দত্ত অনশন শুরু করেন। প্রথমে মতান্তর থাকলেও এই অনশনে যোগ দেন যতীন দাসও। ব্রিটিশ জেল এত সহজে ভারতীয় বিপ্লবীদের পরাক্রমের কাছে মাথা নত করতে রাজি ছিল না। শুরু হয় অত্যাচার। জোর করে অনশনভঙ্গের নানা চেষ্টা।
হার মানেননি বিপ্লবীরা। হার মানেননি যতীন্দ্রনাথ দাস। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনশন চালিয়ে গিয়েছেন। ১৯২৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যু তাঁর সমস্ত শারীরিক কষ্টে ইতি টানে। ঘড়িতে তখন বেলা ১.০৫। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন মধ্যগগনে। লাহৌরের জেল থেকে অগুনতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা নিয়ে ২৫ বছরের তরুণের দেহ যখন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছয়, তখন মাছি গলারও জায়গা ছিল না। কে নেই সেই ভিড়ে?
তবে সবথেকে আলাদা লেগেছিল ৫২ বছরের এক প্রৌঢ়কে। ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, 'ছেলের জন্য আজ ভীষণ গর্বিত। আমি সবথেকে গর্বিত বাবা।'বঙ্কিমবিহারী দাস দেখেছিলেন, যে ছেলেকে একদিন লেখাপড়ায় মন দিতে বলে বকুনি দিয়েছিলেন, তাঁর পায়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রণাম করছেন। তরুণের ত্যাগ যে বৃথা যাবে না, সেই অঙ্গীকারও করছেন এই বঙ্গসন্তান। আইসিএসের চাকরি ছেড়ে ইনিও এগিয়ে এসেছেন দেশের কাজে।
ঠিকই বলেছিলেন যতীন...দেশ সকলের আগে। জীবনের আগে...মৃত্যুকে ছাড়িয়ে।
(তথ্যসূত্র: Dictionary Of Martyrs Of India's Freedom Struggle By Ministry Of Culture, Govt. Of India)
আরও পড়ুন:৯ দশক পর লাইব্রেরিতে ফিরল বই, 'লেট ফি'? মোটে ৫ ডলার