Kolkata Hand Craft Fair 2021: অকাল বৃষ্টি-দুর্যোগে মন্দা হস্তশিল্পে, মেলার শেষবেলায় ক্রেতার পথ চেয়ে চিত্রকররা
'দিদি আমার থেকেও কিছু একটা কেনো না'! মেলায় বেশ খানিকটা ভেতরের দিকে ঢুকে বাঁ দিকে। হাতে তৈরি ঢালাও ঝুড়ি নিয়ে বসে রয়েছেন মুর্শিদাবাদ থেকে আসা তরুণী রুকসানা। ওর থেকে ঝুড়ি কিনে ফেরার সময়েই ডাকটা কানে এল। পরনে চুরিদার আর কার্ডিগান। মাঠের ময়লা মেখে চুল অগোছালো। শুকনো মুখে নির্ভেজাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয় বছর ১৪-র কিশোরী।
Download ABP Live App and Watch All Latest Videos
View In Appখুব বেশি নয়, দাম ওই ২০ থেকে ১০০ মধ্যেই। 'কিছু একটা কিনে নিয়ে যাওয়ার' আর্জি নিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে বাঁশের তৈরি ফুল। দাম? মাত্র ৫০ টাকা। একটু কোণের দিকে জায়গা মেলায় ওর বিক্রি কম। তাই চলতি মানুষদের মাঝে মধ্যেই ডেকে ২০-৩০ টাকার জিনিস কিনে নিয়ে যাওয়ার আবদার করছে ওই কিশোরী। ছবিটা নিউটাউন ইকোপার্কের হস্তশিল্প মেলা প্রাঙ্গনের।
মহামারীর ধাক্কা সামলে সবেমাত্র ছন্দে ফিরছে শহর, জেলা তথা সমগ্র রাজ্য। বিগত দু-বছরে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি। আর এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প।
নিউটাউন ইকো পার্কের এক নম্বর গেট। হাতের কাজের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিল্পীরা। কেউ এসেছেন মুর্শিদাবাদ থেকে, কেউ পূর্ব কেউ বা পশ্চিম মেদিনীপুর। কেউ আবার বর্ধমানের বাসিন্দা। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে মেলায় এসে দোকান দিয়েছেন এই শিল্পীরা।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে চলছে হস্তশিল্প মেলা। নিজেদের তৈরি সামগ্রী বিক্রি করতে এসেছেন বহু মানুষ। আপাতত এই কদিন মাঠই তাঁদের ঠিকানা। ওই মাঠের অস্থায়ী ঘরেই থাকছেন শিল্পীরা। রান্না-খাওয়া চলছে সেখানেই।
বিক্রি-বাটা কেমন চলছে? রোজগার হচ্ছে কি? 'হ্যাঁ হচ্ছে তো' হাসি হাসি মুখেই উত্তর দিলেন মালদার ছবি চিত্রকর। তাহলে এই যে মহামারী আর বৃষ্টি-বাদলা! ক্ষতি হয়নি? হয়েছে তো বটেই তবে সে সব বলতে নারাজ বছর ৬৫-র বৃদ্ধা। দিন তো কেটে যাচ্ছে। তাতেই খুশি তিনি।
সদ্য ক্লাস সেভেনের পরীক্ষায় পাশ করে কাকার সঙ্গে কলকাতা চলে এসেছে দুর্গাপুরের রাহুল। পড়াশোনার ক্ষতি? 'পরীক্ষা তো শেষ। রেজাল্ট বেরোলেই ক্লাস এইট। খুব ভাল পরীক্ষা দিয়েছি। অনেক নম্বর পাব।' পড়াশোনা ছাড়া আর কী করো? প্রশ্নের উত্তর এল, 'পড়াশোনার ফাঁকে বাবা, মা, কাকা হাতে হাতে সাহায্য করি। আঁকতে আমার ভীষণ ভাল লাগে।'
এক রত্তি মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে মেলায় জিনিসপত্র বিক্রি করতে এসেছে উত্তর দিনাজপুরের আলাদিন। এই আলাদিনের পসরাতে আশ্চর্য প্রদীপ না থাকলেও রয়েছে আরও রঙিন সব জিনিস। মাটির প্রদীপ থেকে শুরু করে থালা, ফুলদানি, লক্ষ্মীর ঘট। বিকিকিনি চলছে। আর তারসঙ্গে এই আলো ঝলমলে হাইরাইজ নিউটাউনের রাস্তাতেই আপাতত চলছে ওদের দাম্পত্য-যাপন। সোয়েটার, টুপি জড়িয়ে দিব্যি খেলে বেড়াচ্ছে খুদেও।
মেলার মূল গেট দিয়ে ঢুকেই খানিকটা এগিয়েই দেখা মিলবে রুকসানার। বিক্রি হচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করাতেই তাঁর উত্তর, 'না দিদি, আজ সবাই দেখেই চলে যাচ্ছে। কিনছে না কেউ।'
খানিক এগিয়ে বসেছেন আরেকজন। হাতে আঁকা বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছেন তিনি। রয়েছে মাটির পুতুল থেকে হাড়ি-কড়া সব। বৃষ্টি বাদলায় ব্যবসা জমছে না। নিম্নচাপের খবরে মেলা ছেড়ে বাড়িই চলে গিয়েছিলেন তিনি। আবার ফিরেছেন। তবে তাঁর আক্ষেপ সায়েন্স সিটি মেলা প্রাঙ্গনেই বিক্রি বেশি। এখানে ঠিক মন ভরছে না তাই।
বেশিরভাগেরই বিশেষ বিক্রি নেই। তবে যতটুকু বিক্রি হচ্ছে তাতেই খুশি তাঁরা। অভিযোগ নেই। নালিশও। শুধু সামনে এগোনোর সময়ে কেউ কেউ বলেই বসছেন। 'একটা কিছু কিনে নিয়ে যাও না দিদি।'
কথা বলে বোঝা গেল সপ্তাহান্তে অর্থাৎ শনি-রবিতেই ভিড় বেশি, বিক্রিও। বাকি দিনগুলোয় যাঁরা আসছেন তাঁরা বেশিরভাগই দর্শক।
তবে সোশাল মিডিয়ার রমরমার যুগে খানিক উপকারই হয়েছে ওদের। কথা বলতে বলতেই বোঝা গেল, ফেসবুক-ইনস্টায় ইউজারদের ছবি ভিডিও দেখে আকৃষ্ট হয়ে এসেছেন অনেকেই। বিক্রিও হয়েছে তার দৌলতে। তাই ক্যামেরা খুললেই বেশ উৎসাহিত হয়ে হাসছেন ওঁরা।
কোথাও রকমারি আলো, কোথাও মন মাতানো হাতের কারুকার্য। ইকোপার্ক আদতেই মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। রয়েছে পটচিত্র শিল্পীরাও। আঁকছেন নিজ মনে। গিয়ে ইচ্ছে প্রকাশ করলে ছবির গল্প বলে গানও শোনাবেন সেরামুদ্দিন চিত্রকররা। আর এভাবেই জায়গায় জায়গায় ঘুরে এখনও পটচিত্রকে বাঁচিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন ওঁরা।
মেলায় মাটির আলো, টেবিল ল্যাম্পসহ আলোও রয়েছে বিক্রির তালিকায়।
মেলাজুড়ে রঙ আর শিল্পের বৈচিত্র যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে জীবনযাপনের বৈচিত্র। দু-একজনের সঙ্গে হেসে কথা বললেই সুদূর গ্রামের গল্প শোনাবেন ওরা। জীবনযাত্রা, কীভাবে কাটে গোটা বছর, রোজগার, সব নিয়েই অকপট।
শেষ বেলায় সামান্য লাভ রেখেই জিনিসপত্র বেচে দিতে চাইছেন শিল্পীরা। আগামী ২০ ডিসেম্বর মেলার শেষ দিন। মহামারী, দুর্যোগ সবমিলিয়ে বেজায় ক্ষতি হয়েছে আগেই। তাই যতটুকু সম্ভব আয়ের আসায় বুক বেঁধে শীতের সন্ধে কাটাচ্ছেন চিত্রকররা। বেশিরভাগ হাতে তৈরি জিনিসের দামও সাধ্য়ের মধ্য়েই।
গয়না, ঘর সাজানোর সামগ্রী, বড়ি সবই পাবেন এখানে। তাই সময় করে ঘুরে আসতেই পারেন এই মেলায়।
- - - - - - - - - Advertisement - - - - - - - - -