শুভেন্দু ভট্টাচার্য, কোচবিহার : সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাস করতেন কোচবিহারের মহারাজারা। সেই পথে হেঁটেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠেছে কোচবিহারের রাস উৎসব । কোচবিহারের বিভিন্ন উৎসব দেখলেই সর্বধর্ম সমন্বয়ের এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। 


এই পরিস্থিতিতে ২৬ নভেম্বর রাস পূর্ণিমার দিন মদন মোহন মন্দিরে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে মদন মোহন দেবের রাস উৎসব। আর তাকে কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে প্রস্তুতি তুঙ্গে। এবছর কোচবিহারের নতুন জেলাশাসক অরবিন্দ কুমার মিনা রাস চক্র ঘুরিয়ে এই উৎসবের সূচনা করবেন। একসময় কোচবিহারের মহারাজারা রাস চক্র ঘুরিয়ে রাস উৎসবের সূচনা করতেন। এখন মহারাজারা নেই, তাই এর দায়িত্বে কোচবিহারের জেলাশাসক। প্রথা অনুযায়ী পুজো ও যজ্ঞের পরে জেলাশাসক রাস চক্র ঘুরিয়ে এই উৎসবের সূচনা করেন। 


কোচবিহারের রাজ পরিবারের কুলদেবতা মদনমোহন। ১৮৯০ সালে কোচবিহারের তৎকালীন মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে মদন মোহন মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় কোচবিহারের রাজপ্রাসাদ থেকে মদনমোহন দেবকে নিয়ে আসা হয় মন্দিরে। তারপর থেকেই এই রাস উৎসবের সূচনা। বংশপরম্পরায় এই রাস উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ রাস চক্র তৈরি করে আসছে আলতাফ মিঞার পরিবার। এবছরও তাঁর অন্যথা হয়নি। আলতাফ মিঞা অসুস্থ হলেও, তাঁর ছেলে এবার ঐতিহ্যবাহী সেই রাস চক্র তৈরির দায়িত্ব নিয়েছেন। হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের সংমিশ্রণে তৈরি এই রাস চক্র। যা ঘুরিয়ে পুণ্য অর্জন করেন অগণিত মানুষ। ১৫  দিনের এই উৎসব উপলক্ষে মদনমোহনবাড়ি চত্বরে বসে মেলা। থাকে যাত্রাপালা, ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান। এছাড়াও কোচবিহারের লোকসংস্কৃতির ছোঁয়া দেখা যায় মদনমোহন মন্দিরের সাংস্কৃতিক মঞ্চে। শুধুমাত্র কোচবিহার জেলা নয়, পার্শ্ববর্তী অসম থেকেও প্রচুর মানুষ ভিড় জমান এই উৎসবে।  


রাস উৎসবকে সামনে রেখে আয়োজিত হয় রাসমেলার। কোচবিহার পুরসভা এই মেলার দায়িত্বে। কোচবিহারের মহারাজারা যখন ভেটাগুড়িতে ছিলেন, সেই সময় থেকে এই রাস মেলার সূচনা। বর্তমানে এই মেলার আয়োজনের দায়িত্বে কোচবিহার পুরসভা। এবছর ২১২তম বছরে এই রাস মেলা। 


কোচবিহারের রাসমেলা এক কথায় বিশাল আয়োজন হয়। শ'য়ে শ'য়ে দোকান, নাগরদোলা, সার্কাস প্রদর্শনী আরও কত কিছু। শুধুমাত্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকেই নয়, বিদেশ থেকেও অনেক দোকানি রাস মেলায় ভিড় জমান তাঁদের পসরা নিয়ে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় মেলা কোচবিহারের এই রাসমেলা। মদনমোহনের রাজ চক্র ঘুরিয়ে মেলা ঘোরা এখানকার সাধারণ মানুষের রীতি। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই রাস মেলার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি আর্থিক দিক থেকেও।


কোচবিহারে দুর্গাপুজো বা দীপাবলির পর ব্যবসায়ীরা এই রাস মেলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয় এই রাস মেলাকে কেন্দ্র করে। কয়েক দিনের জন্য পর্যটকদের সমাগম হয় কোচবিহারে। রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রচুর পর্যটক এসে হাজির হন কোচবিহারে , হোটেলগুলিতে জায়গা পাওয়াই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কোচবিহারের মদনমোহন দেবের রাস মেলা শিল্প সংস্কৃতির এক অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠেছে বছরের পর বছর ধরে।