কলকাতা: কামনাই সর্বপাপের মূল — ইন্দ্রিয় সংযম ও আত্মশক্তি প্রয়োগ কামনাদমনের উপায় । দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ বর্ণনায় গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের কর্মযোগে আত্মসংযম এবং কামনা ও অহঙ্কার বর্জনাদির উপদেশ দিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ।       


নিয়তং কুরু কর্ম্ম ত্বং কর্ম্ম জ্যায়ো হ্যকর্ম্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্ম্মণঃ।।


ভাবার্থ-  নিয়ত কর্ম্ম কর কর্ম্মশূন্যতা অপেক্ষা কর্ম্ম শ্রেষ্ঠ, কর্ম্ম না করিয়া তোমার দেহযাত্রাও নির্ব্বাহ হইতে পারে না।


শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন- কর্ম অপেক্ষা সমবৃদ্ধিই শ্রেষ্ঠ। যদিও অর্জুন জানতে চান, সর্বকামনা বর্জনপূর্বক সাম্যবুদ্ধি লাভ করিলেই তো জীবের মোক্ষলাভ হয়, কর্মের আবশ্যকতা কি? 


শ্রীভগবান বলেছেন মোক্ষলাভের দুই মার্গ আছে, এক সন্ন্যাস-মার্গ বা সাংখ্য-মার্গ, আর কর্মযোগ মার্গ। সন্ন্যাসমার্গে যে মোক্ষলাভ হয় তাহা জ্ঞানের ফলে, কর্ম- ত্যাগের দরুণ নয় : আর কর্মযোগে যে সিদ্ধি লাভ হয় তাহাও সমস্ত বুদ্ধি বা সম্যক জ্ঞানের ফলে, এই জন্যই তোমাকে কর্মোপদেশ দিতেছি অথচ সাম্যবুদ্ধির প্রশংসা করিতেছি, উহা ব্যতীত কর্ম নিষ্কাম হয় না। কিন্তু জ্ঞান শ্রেষ্ঠ বলিয়াই কি তুমি কর্ম ত্যাগ করিতে পার ? প্রকৃতির গুণে বাধা হইয়াই তোমাকে কর্ম করিতে হইবে। দেহধারী জীব একেবারে কর্ম ত্যাগ করিতেই পারে না। 


আরও পড়ুন, 'জীবনের উত্থান-পতন নিজেদেরই হাতে থাকে', কীভাবে সফল হওয়া যায় গীতায় বলেছেন শ্রীকৃষ্ণ


গীতার কথায়, যাহারা বাহ্যতঃ কর্ম ত্যাগ করিয়া মনে মনে বিষয়-চিন্তা করে তাহারা মিথ্যাচারী, কিন্তু যাঁহারা ইন্দ্রিয়সকল সংযত করিয়া অনাসক্তভাবে কর্ম করেন তাঁহারাই শ্রেষ্ঠ। অতএব তুমি অনাসক্তভাবে কর্তব্য কর্ম কর, কর্ম ত্যাগ অপেক্ষা কর্মই শ্রেষ্ঠ। জনকাদি রাজর্ষিগণ কর্ম দ্বারাই সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। আমিও লোক- শিক্ষার্থ স্বয়ং কর্মে ব্যাপৃত আছি। নিষ্কাম কর্মের তিনটি লক্ষণ (১) সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ (২) ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন, (৩) কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ। 


রাগদ্বেষের বশবর্তী না হয়ে ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, লোকে কামনার বশবর্তী হইয়া পাপ আচরণ করে, স্বধর্ম ত্যাগ করিয়া পরধর্ম গ্রহণ করে, কর্তব্যভ্রষ্ট হয়। কামনাই সকল অনর্থের মূল। ইন্দ্রিয়সকল সংযমপূর্বক আত্মাকে আত্মজ্ঞানের প্রয়োগেই নিশ্চল করিয়া আত্মনিষ্ঠ হও, পরমেশ্বরে চিত্ত সমাহিত কর, তাহা হইলেই কামনা জয় করিতে পারিবে, নিষ্কাম কর্ম যোগ সাধনে সিদ্ধিলাভ করিতে পারিবে।


গীতায় কী বলা হয়েছে?


এই অধ্যায়ে অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে সেই বিরোধেরই নিরসন করিয়া জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয় সাধন করার কথা বলা হয়েছে। জ্ঞানীদিগেরও নিষ্কামভাবে যথাপ্রাপ্ত কর্তব্য-কর্ম করা উচিত, পুনঃ পুনঃ এই উপদেশ দেওয়া হইয়াছে। কেবল তাহাই নহে, যাহারা অজ্ঞান, যাহারা সংসারাসক্তিবশতঃ কর্মে নিযুক্ত আছে, তাহাদিগকেও কর্ম হইতে বিচলিত করা কর্তব্য নহে, এই উপদেশ দেওয়া হইয়াছে। 


 


( তথ্যসূত্র : শ্রীমদভগবদ্ গীতা, (তত্ত্ববিবেচনী), গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর )