কলকাতা: সনাতন ধর্ম অনুসারে, হিন্দুরা গীতা (Gita) -কে ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী মনে করেন। গীতা-র কথক কৃষ্ণ হিন্দুদের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের অবতার পরমাত্মা স্বয়ং। তাই গীতা-য় তাঁকে বলা হয়েছে “শ্রীভগবান”। (Religion) 


গীতায় তিনি বারংবার বলেছেন, ভগবান জন্মরহিত। তিনি অবিনাশী স্বরূপ এবং সর্বপ্রাণীর ঈশ্বর হওয়া সত্ত্বেও নিজ প্রকৃতিকে অধান করে নিজ যোগমায়ার দ্বারা প্রকটিত হন। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ (Lord Krishna) বলেছেন- 


ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ ।


ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃ পরম্।।


ভগবান অর্জুনকে বলেছেন যে, যে ভীষ্মাদি স্বজনদের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়, তাঁদের জন্য তুমি শোক করছ। অতএব জানতে ইচ্ছা হয় যে, কেন তাঁদের জন্য শোক করা উচিত নয় ? তাই ভগবান প্রথমে আত্মার নিত্যতা প্রতিপাদন করে আত্মদৃষ্টিতে তাঁদের জন্য শোক করা অনুচিত বলে প্রমাণ করেছেন। এমন নয় যে, আমি কোনো কালে ছিলাম না বা তুমিও ছিলে না, অথবা এই রাজন্যবর্গ ছিলেন না এবং পরেও যে আমরা সকলে থাকব না, তাও নয়৷৷ 


এই শ্লোকটিতে ভগবানের কথার অভিপ্রায় কী ?


তোমার-আমার কখনো কোনো কালে বিনাশ নেই। বর্তমান শরীরের উৎপত্তির আগেও আমরা ছিলাম, পরেও থাকব। শরীর নাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না, অতএব বিনাশের আশঙ্কায় এঁদের সকলের জন্য শোক করা অনুচিত। এই শ্লোকে ভগবান আত্মরূপে সকলের নিত্যতা সিদ্ধ করে এই ভাব প্রকাশ করেছেন যে তুমি যাঁদের বিনাশের আশঙ্কা করছ, তাঁদের সকলের এবং করা উচিত নয়।


এই ভাবে আত্মার নিত্যতা প্রতিপাদন করে এবার তার নির্বিকারত্ব প্রতিপাদন করে আত্মার জন্য শোক করা যে অনুচিত তা প্রমাণ করেছেন। 


দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা। 
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহাতি৷৷ 


যেমন দেহীর (জীবাত্মার) এই দেহে কৌমার, যৌবন এবং বৃদ্ধাবস্থা উপস্থিত হয়, তেমনিই ভিন্ন দেহের প্রাপ্তি হয় ; ধীর ব্যক্তিগণ এই বিষয়ে মোহগ্রস্ত হন না৷৷ 


এই শ্লোকটিতে ভগবানের বলার অভিপ্রায়? 


এই শ্লোকে আত্মাকে বিকারশীল মনে করে অজ্ঞান ব্যক্তিগণ তাকে এক দেহ থেকে অন্য দেহে যাওয়াকে কষ্টকর মনে করে শোকগ্রস্ত হন ; সেটি অনুচিত বলে ভগবান জানিয়েছেন। ভগবান বলেছেন যে প্রকার কৌমারত্ব, যৌবন প্রাপ্তি এবং জরাগ্রস্ত অবস্থা আত্মার হয় না, স্থূল শরীরেরই হয় এবং সেটি আত্মার করা উচিত নয়। এক দেহ থেকে অন্য দেহে যাওয়া-আসাও প্রকৃতপক্ষে আত্মার হয় না, সূক্ষ্ম শরীরেরই হয় এবং তা আত্মার ওপর আরোপিত হয়। তাই এই তত্ত্ব যাঁরা জানেন না, সেই অজ্ঞ ব্যক্তিরা দেহান্তর প্রাপ্তিতে শোক প্রকাশ করেন, ধীর, জ্ঞানী ব্যক্তিরা করেন না ; কারণ তাঁদের দৃষ্টিতে আত্মার সঙ্গে শরীরের কোনো সম্পর্ক নেই। 


আগের শ্লোকে ভগবান আত্মার নিত্যত্ব এবং নির্বিকারত্ব প্রতিপাদন করে তার জন্য যে শোক করা উচিত নয়, তা প্রমাণ করেছেন ; তাতে এই প্রশ্ন আসতে পারে যে আত্মা নিত্য ও নির্বিকার হলেও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সংযোগ-বিয়োগাদিতে যে সুখ-দুঃখের প্রত্যক্ষ অনুভূতি হয়, তাতে শোক না করে কি থাকা যায় ? তাতে ভগবান নির্দেশ দিচ্ছেন যে সর্বপ্রকার সংযোগ-বিয়োগ অনিত্য জেনে তা সহ্য করা উচিত।



( তথ্যসূত্র : শ্রীমদভগবদ্ গীতা, (তত্ত্ববিবেচনী), গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর )