কলকাতা: “আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল/ পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল রে হরিবোল!” এই ছড়াটি শুনতেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল তো? পড়তেই হবে! দোলের ঠিক আগের রাতে এই ন্যাড়াপোড়ার সাক্ষী থাকেনি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কিন্তু যাবে না।
কিন্তু জানেন কি, কী এই ন্যাড়াপোড়া? কেনই বা এটি পালিত হয়? এর ব্যাখ্যা রয়েছে পুরাণে। ঘটনাটি সত্যযুগের। দুর্দমনীয় দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর অত্যাচারে সন্ত্রস্ত গোটা ত্রিলোক। ব্যাতিক্রম একমাত্র হিরণ্যকশিপুর নিজপুত্র প্রহ্লাদ। কারণ সে ছিল বিষ্ণুভক্ত। রাতদিন শুধু হরিনাম জপত। কিন্তু এদিকে হরি হিরণ্যকশিপুর চরম শত্রু।
ক্রুদ্ধ দৈত্যরাজ বাধ্য হয়েই ছেলেকে সহবত শেখানোর নানারকম চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। হিরণ্যকশিপু যে পরিকল্পনাই করেন, বিষ্ণু মায়া প্রয়োগ করে তা-ই ভেস্তে দেন। অগত্যা হিরণ্যকশিপু নিজের ছেলেকে হত্যা করার দায়িত্ব দিলেন ভগিনী হোলিকাকে। এই হোলিকার একটি বিশেষ ধরণের চাদর ছিল। যা তাকে পিতামহ ব্রহ্মা বর দিয়েছিলেন। এই চাদরটি গায়ে থাকাকালীন বাহ্যিক কোনো বস্তুই তাকে স্পর্শ করতে পারত না। পরিকল্পনা করা হল, এই চাদর পরিহিতা অবস্থায় হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ভেতরে বসবে। ফলস্বরূপ, হোলিকার কোনও ক্ষতি হবে না, কিন্তু প্রহ্লাদ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ফাল্গুনী পূর্ণিমার ঠিক আগের রাতে চাদর পরিহিতা হোলিকা ভাইপো প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করে। ভক্তের ডাকে ব্যাকুল বিষ্ণু এমন এক ভেলকি দেখিয়ে দিলেন যে, ব্রহ্মার চাদর হোলিকাকে অনাবৃত করে প্রহ্লাদের গায়ে এসে জড়াল। ফলস্বরূপ সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে যায় হোলিকা। আর প্রহ্লাদ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।
স্কন্দপুরাণ অনুসারে, এই বিশেষ দিনেই ভগবান বিষ্ণু হোলিকা দহনের মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন। ফলে আজও দিনটিতে ভারতবর্ষের নানা স্থানে রাক্ষসী হোলিকা তথা অশুভ শক্তির রূপক হিসেবে পুরানো ডালপালা, আগাছা ইত্যাদি পুড়িয়ে ‘নাড়াপোড়া’ পালন করা হয়। নাড়া অর্থাৎ ধান কাটার পর ধানগাছের গোড়ায় যে অবশিষ্টাংশ পড়ে থাকে। চলতি কথায় ‘ন্যাড়াপোড়া’ হয়ে গিয়েছে। তবে অন্য একটি মতে, শিশু শ্রীকৃষ্ণের পূতনা বধ উপলক্ষ্যে পালন করা হয় ন্যাড়াপোড়া। আবার কেউ কেউ বলেন, কৃষ্ণ ন্যাড়া নামক অসুরকে বধ করেছিলেন। সেই উপলক্ষ্যে ন্যাড়াপোড়া।
আরও পড়ুন, 'ভেষজ রং' লেখা দেখেই বিশ্বাস নয় ! হতে পারে ত্বক-চোখের বিরাট ক্ষতি,কীভাবে বাঁচবেন
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বসন্তকালে দোল বা হোলি উৎসব পালন করা হয় । বসন্ত ঋতু মানেই আবহাওয়ার এক বিরাট পরিবর্তন অনুভূত হয়। কখনও গরম তো আবার কখনও ঠান্ডা, এই রকমই মিশ্র আবহাওয়া সৃষ্টি হয় এই সময়ে। যার ফলে বাতাসে এই সময় যাবতীয় রোগ-জীবাণু-ব্যাকটেরিয়া ভেসে বেড়ায়। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের শারিরীক সমস্যা যেমন ফ্লু, ভাইরাসঘটিত জ্বর এবং পক্সের মতো ইত্যাদি রোগের উপদ্রব দেখা দেয়। এছাড়াও এই সময়ে গাছের শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। যার ফলে এইসব পাতা আবর্জনার রূপ নেয়। আর এই কারণেই ঝরে যাওয়া শুকনো নারকেল পাতা, সুপুরির পাতা ইত্যাদি জড়ো করে তা পুড়িয়ে দেওয়ার হয়। এর ফলে সৃষ্টি হওয়া জীবাণু আগুনের সংস্পর্শে এসে নষ্ট হয়ে যায় তার পাশাপাশি এই প্রথাটি খুবই পরিবেশবান্ধব বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।