কলকাতা : লোকদেবী মা ষষ্ঠী। বৈদিক শাস্ত্রে  মা ষষ্ঠীর উল্লেখ নেই বটে, কিন্তু বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে প্রায় নিত্য পূজিত তিনি। মানুষের বিশ্বাস, ষষ্ঠীর কৃপায় সন্তানের মঙ্গল হয়। বিভিন্ন ষষ্ঠী পালন করা হয় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন মাসে, ‘ষষ্ঠীর থানে’ পুজো দেন মায়েরা। তাঁর কৃপায় নাকি সন্তান আসে কোলে। সন্তানরা সুস্থভাবে বড় হয়। বাংলার মায়েরা জামাইকে সন্তানের দৃষ্টিতেই দেখেন, তাই জামাইয়ের মঙ্গলকামনাতেও পালিত হয় একটি ষষ্ঠী। জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী পালন করা হয় জামাইয়ের জন্য । জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লা পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে জামাই ষষ্ঠী। 


 এই ব্রতর প্রচলন কীভাবে 


ধারণা, মঙ্গলকাব্যের যুগ থেকেই বাংলায় বিভিন্ন লোকদেবীর পুজো শুরু। সারা বছর আরও বেশ কিছু ষষ্ঠী তিথি পালিত হয়। কিন্তু জামাইয়ের মঙ্গলকামনাায় এই ষষ্ঠীপালনের সঙ্গে যেমন জামাইয়ের মঙ্গলের বিষয়টি জুড়ে আছে, তেমনই আছে আরেকটি কারণ। মনে করা হয়, তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা একবার শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে , তেমন করে আর বাপের বাড়ি আসা হত না। তাই জামাইকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ সারতেন বাবা-মায়েরা। আর সেই সুযোগে মেয়েদের বাপের বাড়ি আসাও হত বটে। পাশাপাশি শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্ককেও সুদৃঢ় হত এই আচারের মাধ্যমে।   কন্যার সন্তান হওয়ার কামনাও করা হত। 


 জামাই আদরের রীতি


ষষ্ঠীর কোনও মূর্তি হয় না। লোকদেবী ষষ্ঠীর প্রতীক গাছে নিবেদন করা হয় পুজো।  জৈষ্ঠ্য মাসে বাংলার গাছগাছালি আম, জাম, লিচু, কাঁঠালে ভরে ওঠে ৷ তাই শাশুড়িরা ষষ্ঠীর দিন জামাইকে এই ফলের থালা সাজিয়ে দেন ৷  জামাইয়ের  কপালে মঙ্গলকারী দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করেন।  জামাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনায় মা ষষ্ঠীর তেল-হলুদের ফোঁটাও দেন। তেল-হলুদে ডুবিয়ে সুতো কবজিতে বেঁধে দেন শাশুড়ি-মা ৷ জামাইকে নতুন বস্ত্র উপহার দেওয়া হয় শ্বশুরবাড়ি থেকে। সেই সঙ্গে জামাইও শাশুড়িকে প্রণামী বস্ত্র দেন। জামাইকে আদরে খাওয়ান শাশড়িরা। এই সময়ে জামাইকে হাত পাখা দিয়ে পাখা দেওয়ার প্রথাও রয়েছে। 


জামাইষষ্ঠীই ছিল মেয়েকে দেখার একটি উপায়


আগেকার দিনে একটা রীতি ছিল যখন,  মেয়েদের  সন্তান হওয়ার আগে অবধি বাপের বাড়ি আসতে দেওয়া হত না। এছাড়া মেয়েরা গর্ভধারণ করলেও আসতে পারতেন না। আগেকার দিনে পরের পর সন্তান জন্মানো ও শিশুমৃত্যুর মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও ঘটত প্রায়শই। তাই মেয়েরা আসতে পারতেন না। এই জামাইষষ্ঠীই ছিল মেয়েকে দেখার একটি উপায়। যখন জামাইকে নেমন্তন্ন করতে মা-বাবা যেতেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আর মেয়েও আসতেন বাপেরবাড়ি। 


জামাই ষষ্ঠীর ব্রতকথা 


অন্যান্য ষষ্ঠীর মতো জামাই ষষ্ঠীরও আছে একটি ব্রতকথা। তার গল্পটা কিছুটা এরকম। এক বাড়িতে দুটি বউ ছিল ৷ ছোট বউয়ের নাকি খাওয়া দাওয়ার প্রতি লোভ ছিল একটু বেশি ৷ বিশেষত  মাছের প্রতি তার খুব ভালবাসাা ছিল। আর সে যুগে বউদের পাতে মাছ-মিষ্টি আর জুটত কই ! তাই সে ভাল খাবার সরিয়ে রাখত চোখের আড়ালে।  ভাল খাবার রান্না হলেই খেয়ে নিত লুকিয়ে লুকিয়ে । আর দোষ চাপাত এক বিড়ালের উপর। আর বিড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন ৷ তাই এই মিথ্যে অভিযোগ শুনে মা ষষ্ঠী যেতেন রেগে।  এরপর  ছোট বউয়ের  সন্তান হওয়ার পর মা ষষ্ঠীর কোপে সে মারা যায়। একের পর এক সন্তান আসত কোল জুড়ে। আর মারা যেত। তারপর একদিন ছোট বউয়ের কপালে জুটল অলক্ষণা বদনাম। বাড়ি থেকে জুটল ঘাড়ধাক্কা। বউ গেল অরণ্যে। সেখানে বসে বসে কাঁদতে লাগল  সে ৷ শেষে মা ষষ্ঠীর দয়া হয়। তিনি বৃদ্ধার বেশে তার কাছে এসে জানতে চাইলেন কী ঘটেছে। সব শুনে তিনি  জ্যৈষ্ঠে অরণ্য ষষ্ঠী পালনের পরামর্শ দিলেন। ছোটবউ এরপর  ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করে। ফিরে পায় মরা ছেলে মেয়েদেরও। এটাই জামাইষষ্ঠীর ব্রতকথা। এই ষষ্ঠীকে অরণ্যষষ্ঠীও বলা হয়।