ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের তরফ থেকে মিলেছে ‘বেস্ট ট্যুরিজ়ম ভিলেজ অফ ইন্ডিয়া’র তকমা পেয়েছে মুর্শিদাবাদের গ্রাম কিরীটেশ্বরী । সারা দেশ থেকে জমা পড়েছিল ৭৯৫টি আবেদন। এর মধ্যে ভারত সেরার মুকুট পেল বাংলার এই গ্রাম। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে মিলবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। কেন প্রসিদ্ধ এই গ্রাম ? এই মন্দিরেই অধিষ্ঠান করেন দেবী কিরীটেশ্বরী। মন্দিরটি মুর্শিদাবাদের দহপাড়া রেল স্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। 


এই দেবস্থান সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম। এখানে সতীর মুকুট বা কিরীট এখানে পড়েছিল। সেই কারণে দেবীকে ‘মুকুটেশ্বরী’ বলেও ডাকা হয়। ইতিহাস ঘেটে যতদূর জানা যায়, ১৪০৫ সালে দেবীর প্রাচীন মন্দিরটি ভেঙে পড়ে। তার পরে ১৯ শতকে লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণ রায় নতুন মন্দির নির্মাণ করান। ভাগীরথী তীরে এই দেবস্থানে আজ হাজার হাজার শাক্ত-বিশ্বাসীর সমাগম হয়।


এই মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল, এখানা দেবী শিলাস্বরূপা। তাঁর কোনও নিয়তাকার মূর্তি এখানে নেই। কোনও ছবিও এখানে পূজিত হয় না। একটি লাল রঙের শিলাকেই এখানে মাতৃজ্ঞানে পূজা করা হয়। শিলাটি একটি আবরণ দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। প্রতি বছর দুর্গাষ্টমীতে এই আবরণটি পরিবর্তন করা হয়। সতীর কিরীট, যার মহিমাতেই এই শক্তিপীঠের উৎপত্তি, তা রানি ভবানীর গুপ্তমঠে সুরক্ষিত রয়েছে। গুপ্তমঠ দেবী মন্দিরের কাছেই অবস্থিত। প্রসঙ্গত, দেবীর প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও নবনির্মিত মন্দিরের সামনে অবস্থান করছে।
 


ইতিহাস মতে, লালগোলার রাজা ভগবান রায়, মুঘল সম্রাট আকবরের কাছ থেকে এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। মহামতি সম্রাট দেবীমহিমাকে অন্তরে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানা যায় সমকালীন সূত্র থেকে। ভগবান রায়েরই বংশধর ছিলেন দর্পনারায়ণ। দুর্গাপুজো, কালীপুজো ছাড়াও এখানে দেবীর বিশেষ পুজো সম্পন্ন হয় মাঘ মাসের রটন্তি অমাবস্যায়। পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবার এখানে একটি বিশেষ মেলা বসে। এই মেলা রাজা দর্পনারায়ণের কাল থেকে বসছে বলে জানা যায়।


১৮ শতকে বাংলায় শাক্তধর্মের এক প্লাবন আসে। এই সময়ে রাজা রামকৃষ্ণ রায়ের মতো সিদ্ধতান্ত্রিক এখানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন বলে জানা যায়। বাংলার ইতিহাসের বহু সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে রযেছে এই মন্দির। এই মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা কিংবদন্তি। একটি কাহিনি থেকে জানা যায়, পলাশীর যুদ্ধের পরে যখন মীরজাফর, নবাবসিরাজ-উদ-দৌলা বিরোধী যড়যন্ত্রে তাঁর অন্যতম সঙ্গী রাজা রাজবল্লভকে ডুবিয়ে মারেন, সেই দিন এই মন্দিরের এক শিবলিঙ্গ নাকি নিজে থেকেই ফেটে গিয়েছিল। তার চাইতেও বড় কথা, মিরজাফর শেষ বয়সে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হন। তিনি তখন নাকি অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন। তাঁর বিশ্বাস জন্মায়, দেবীর চরণামৃত পান করলে তিনি রোগমুক্ত হবেন। দেবীর চরণামৃত মুখে নিয়েই নাকি প্রয়াত হন বাংলার ইতিহাসের অন্যতম বিতর্তিক চরিত্র মিরজাফর।


এই সব কাহিনির সত্য-মিথ্যা নিরূপণ এখানে সম্ভব নয়। তবে এ থেকে এটুকু বোঝাই যায়, দেবী কিরীটেশ্বরীকে বাংলার হিন্দু-মুসলমান তাদের নিজেদের অংশ বলেই ভেবেছে। আব্দুল হাকিম মণ্ডলের এই সংকল্প বা তাঁর পুত্র, লুৎফল হকের তরফে মন্দিরে ভূমিদান বাংলার সেই গৌরবময় ঐতিহ্যেরই অভিজ্ঞান, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।