সোমনাথ মিত্র, জাঙ্গিপাড়া: লাগে না কোনও পঞ্জিকা, জল ঘড়ি দেখে পুজোর প্রত্যেকটি সময় নির্ধারণ করেন ঘড়িয়াল। আর সেই সময় ধরেই পুজো করা হয় মাকে। হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়ার রাজবলহাট (Rajbalhat)এলাকায় প্রায় ৭৮২ বছরের প্রাচীন প্রতিষ্ঠিত দ্বি ভুজা শ্বেতকালী এখানে পূজিত হন মা দুর্গা রূপে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা বৈচিত্র্যময় এই পুজোর রীতিনীতি দেখতে এবং রাজবল্লভী মায়ের (Rajballavi Maa) মহিমায় পুজোর কটা দিন কার্যত জনসমুদ্রে পরিণত হয় গোটা রাজবলহাট এলাকা।


স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বহু বছর আগে দামোদর নদের পূর্ব তীরে ভুরশুট পরগনার অন্তর্গত একটা গ্ৰাম ছিল রাজপুর। কথিত আছে, এখানকার রাজা ছিলেন সদানন্দ মুখোপাধ্যায়। একদা এই রাজপুর এলাকা দিয়ে যাবার সময় একজন কাপালিকের পরামর্শে শ্মশানে সাধনা শুরু করেন সদানন্দ। তারপর মা দেখা দিয়ে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করার আদেশ দেন। মায়ের আদেশ মতোই রাজা সদানন্দ এখানে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। 
   
মন্দিরের একজন পুরোহিত গুরুপদ বন্দ্যোপাধ্যায় দেবীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,"মা নিজে সদানন্দকে তাঁর রূপ নিয়ে জানিয়েছিলেন বড় নারী মূর্তি, ত্রিনয়না, হাস্য মুখমণ্ডল, দ্বি-ভুজা আর গায়ের রং হবে শরৎকালের জ্যোৎস্নার মতো। দক্ষিণ হাতে থাকবে ছুরি আর বাম হস্তে থাকবে পাত্র। এক পা থাকবে ভৈরবের মাথায় আর অন্য পা থাকবে ভৈরবের বুকে। গলায় মুণ্ডমালা আর কোমরে হস্ত বন্ধন। এই আদেশ অনুযায়ী ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি শ্বেত কালী রূপে প্রতিষ্ঠিত হন এবং পূজিত হন দুর্গা রূপে। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত রাজবল্লভী মাকে দুর্গা রূপে পুজো করা হয়। 


পুজোর ১৫ দিন আগে থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে মায়ের বিশেষ পুজো হয়। নবমীতে মোষ, মেষ ও ভেড়া বলি হয়। মন্দিরের প্রবেশ পথে রয়েছে বড় তোরণ। নিজস্ব পুকুর ছাড়াও পাঁচটি আলাদা আলাদা শিব মন্দির আছে মন্দির চত্বরে। সারা বছর মাকে দশম মহাবিদ্যায় পুজো করা হয়। প্রত্যেক দিন মাছ সহকারে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। তবে প্রধান উৎসব বা পুজো বলতে হয় দুর্গা পুজো। 


জলঘড়ির সময়  দেখে এখানে দুর্গা রূপে পূজিত হন শ্বেত কালী। ঘড়িয়াল জল ঘড়ি দেখে এসে মায়ের কাছে জানান দেন পুজোয় সময় হয়েছে। তারপরই শুরু হয় পুজো। শেষ হবার সময়েও ঘড়িয়াল জানিয়ে দিয়ে যান, পুজোর সময় শেষ হয়েছে। সেই মতো পুজো বন্ধ হয়। সকালে নৈবেদ্য ও মিষ্টান্ন দেওয়া হয়। দুপুরে ভাত, ডাল, সবজি  এবং মাছ দিয়ে তৈরি তরকারি মাকে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। রাজবল্লভী মাকে রোজ দুপুরে মাছ ভাত দেওয়া হলেও বছরে দুদিন চৈত্র মাসের সংক্রান্তি ও নবমীতে অন্ন ভোগ হয় না। তার পরিবর্তে মাকে লুচি ভোগ ও ফলাহার দেওয়া হয়। মৃন্ময়ী এই মূর্তি ১২-১৪ বছর অন্তর নিরঞ্জন করা হয়। তারপর কুমোরটুলি থেকে মৃৎশিল্পী এসে প্রতিমা তৈরি করেন এবং মায়ের পুনরায় প্রাণ প্রতিষ্ঠাটা করা হয়। নিত্য পুজোয় পর রাতে মাকে শয়ন দেওয়া হয়। তার আগে তামাক সেঁজে বসিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করা হয়। ফাঁকা হয়ে যায় মন্দির চত্বর এলাকা। পরের দিন পুনরায় খোলা হয় দরজা। 


শ্বেত কালী মন্দিরের অন্য এক পুরোহিত রূপক সাহা চৌধুরী বলেন, "অষ্টমীতে পুকুরে সপ্তডিঙা ভাসানো হয়। সন্ধি পুজো শুরু হবার সময় এখানে অনেক লোক দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘড়িয়াল জল ঘড়ি দেখে জানান দেন পুজো শুরু সময় হয়েছে। সেই মতো এখানকার পুজো শুরু হয়। আর সেই বার্তা লোক মুখে ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজবলহাট এলাকায়। তারপরই অন্যান্য মণ্ডপে সন্ধি পুজো শুরু হয়। এখন অবশ্য অনেক জায়গায় ফোনের মাধ্যমে সন্ধি পুজো শুরুর বার্তা পৌঁছে যায়। আবার জল ঘড়ি দেখে ঘড়িয়াল পুজো শেষ করার নির্দেশ দিলে পুজো সমাপ্ত হয়। যুগ যুগ ধরে এই প্রথা এখনও চলে আসছে রাজবল্লভী মায়ের পুজোয়।


দশমী দিন রাজবল্লভ এলাকার সমস্ত মানুষ প্রথমে মাকে প্রণাম করেন। তারপর বাড়ি গিয়ে পরিবারের অন্যান্য বয়স্ক সদস্যদের দশমীর প্রণাম সারেন। কথিত আছে, বণিক গুরুদাস সপ্তডিঙা করে এখান দিয়ে বাণিজ্য করতে যাবার সময়  এক অপরূপ নারীর দর্শন পান। সেই নারীকে তাঁদের নৌকায় তোলার নির্দেশ দেন বণিক। কিন্তু, সেই নারী যখন একের পর এক নৌকায় পা দেন তখন সবকটিই ডিঙাই ডুবে যায়। সপ্তম ডিঙায় পা দেওয়ার আগে বণিক তাঁর ভুল বুঝতে পেরে মায়ের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চান। তখন দেবী গুরুদাস-কে তাঁর আসল রূপ দর্শন করান এবং নির্দেশ দেন তাঁর মন্দির তৈরির জন্য রাজা সদানন্দ মুখোপাধ্যায়কে গিয়ে অর্থ সাহায্য করতে। বণিক গুরুদাসের চেতনা জাগ্রত হওয়ার জন্য তাঁর ডুবে যাওয়া সবকটি নৌকা, ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্য ফিরিয়ে দিয়ে দেন রাজবল্লভী মা। পৌরাণিক এই কাহিনীর সূত্র ধরেই দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে সপ্তডিঙা ভাসানো হয় মন্দিরের সোজাসুজি পুকুরে।


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।