কলকাতা: গীতা (Gita) বা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (Bhavbat Gita) ৭০০-শ্লোকের ধর্মগ্রন্থ। সাতশত শ্লোকের গ্রন্থ বিধায় একে সপ্তশতী বলে। এটি সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত-এর অংশ। গীতা একটি স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থ তথা পৃথক শাস্ত্র এর মর্যাদা পেয়ে থাকে। মানবধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের ইতিহাসে গীতা এক বিশেষ স্থানের অধিকারী। গীতা-র কথক কৃষ্ণ হিন্দুদের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের অবতার পরমাত্মা স্বয়ং। তাই গীতা-য় তাঁকে বলা হয়েছে "শ্রীভগবান"।


গীতার চতুর্থ অধ্যায় অর্থাৎ জ্ঞান যোগে বলা আছে আত্মার চিন্ময় তত্ত্ব, ভগবৎ-তত্ত্ব এবং ভগবান ও আত্মার সম্পর্ক -এই সব অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান বিশুদ্ধ ও মুক্তিপ্রদায়ী। এই প্রকার জ্ঞান হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভক্তিমূলক কর্মের (কর্মযোগ) ফলস্বরূপ। পরমেশ্বর ভগবান গীতার সুদীর্ঘ ইতিহাস, জড় জগতে যুগে যুগে তার অবতরণের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ গুরুর সান্নিধ্য লাভের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা করেছেন।                        


গীতার ১১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে- 


যে যথা মাং প্রপদারে তাথৈরমম বৰ্ম্মানুবর্তে মনুষ্যাঃ পার্থ পার্থ সর্বশঃ ॥


-হে অর্জুন! যে ভক্ত আমাকে যেভাবে ভজনা করেন, আমিও সেইভাবেই তার ভজনা করি; কারণ সকল মানুষই সর্বতোভাবে আমার পথই অনুসরণ করে ৷৷


 


যে ভক্ত আমাকে যেভাবে ভজনা করেন, আমিও সেইভাবেই তাঁর ভজনা করি—এই কথাটির অর্থ কী ?


এই কথার মাধ্যমে ভগবানের বলার এই তাৎপর্য যে আমার ভক্তদের ভজনা করার প্রকার ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে । নিজ নিজ চিন্তা অনুসারে ভক্তগণ আমার পৃথক্ পৃথক্ রূপ মেনে থাকেন এবং নিজ নিজ মেনে নেওয়া অনুযায়ী আমার ভজন-স্মরণ করেন, আমিও তাই তাঁদের চিন্তা অনুসারে সেই সেই রূপেই দর্শন দান করি। শ্রীবিষ্ণুরূপের উপাসকদের শ্রীবিষ্ণুরূপে, শ্রীরামরূপের উপাসকদের শ্রীরামরূপে, শ্রীকৃষ্ণরূপের উপাসকদের শ্রীকৃষ্ণরূপে, শ্রীশিবরূপের উপাসকদের শ্রীশিবরূপে, দেবীরূপের উপাসকদের দেবীরূপে এবং নিরাকার সর্বব্যাপীরূপের উপাসকদের নিরাকার সর্বব্যাপী রূপেই প্রকাশিত হই ; 


এইভাবে যাঁরা মৎস্য, কূর্ম, নৃসিংহ, বামন প্রভৃতি অন্যান্য রূপে উপাসনা করেন- তাঁদের সেই সেই রূপে দর্শন দিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে থাকি । এছাড়াও তাঁরা যেরূপে যে ভাবে আমার উপাসনা করেন, আমি তাঁদের প্রতি সেই সেই প্রকার ও সেই সেই ভাবেই অনুসরণ করে থাকি । যিনি আমাকে চিন্তা করেন, আমি তাঁর চিন্তা করি। যিনি আমার জন্য ব্যাকুল হন, আমিও তাঁর জন্য ব্যাকুল হই । যিনি আমার বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারেন না, আমিও তাঁর বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারি না । যিনি তাঁর সর্বস্ব আমাকে অর্পণ করেন, আমিও তাঁকে আমার সর্বস্ব অর্পণ করি । যাঁরা গোপবালকদের ন্যায় আমাকে নিজের সখা মনে করে আমর ভজনা করেন, তাঁদের সঙ্গে আমি বন্ধুর মতো ব্যবহার করি । 


যিনি নন্দ-যশোদার মতো পুত্র মনে করে আমার ভজনা করেন, তাঁর সঙ্গে আমি পুত্রের মতোই আচরণ করে তাঁর কল্যাণ করে থাকি । তেমনই রুক্মিণীর ন্যায় পতি মনে করে ভজনকারীদের সঙ্গে পতির মতো, হনুমানের ন্যায় প্রভু মনে করে ভজনাকারীদের সঙ্গে প্রভুর মতো এবং গোপিনীদের মতো মাধুর্য ভাবে ভজনাকারীদের সঙ্গে প্রিয়তমের মতো ব্যবহার করে তাদের কল্যাণ করি এবং তাঁদের আমার দিব্য লীলা রস আস্বাদন করাই। 



মানুষ সর্বভাবে আমার পথই অনুসরণ করে, এই কথাটির ভাবার্থ কী ?


শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, লোকে আমাকে অনুসরণ করে, তাই যদি আমি এইরূপ প্রেম ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করি তাহলে অন্য লোকেরাও আমায় দেখে এরূপই নিঃস্বার্থভাবে একে অপরের সঙ্গে যথাযোগ্য প্রেম ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করবে। অতএব এই নীতি জগতে প্রচার করার জন্যই আমার এরূপ করা কর্তব্য, কারণ জগতে ধর্মস্থাপন করার জন্যই আমি অবতার-রূপ ধারণ করেছি।