নয়াদিল্লি: গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে মোটামুটি। তার আগে অগ্নিপরীক্ষার মুখে ভারতের সৌরযান Aditya-L1. সূর্যের উপর নজরদারি চালাতে ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট (L1)-এ অবস্থান করবে ভারতের সৌরযান। কিন্তু তার আগে ‘হেলো অরবিটে’ প্রবেশ করতে হবে তাকে। এই দুরূহ কাজে সফল হলে তবেই সূর্যের উপর নজরদারি চালানোর প্রশ্ন আসছে। আগামী ৬ জানুয়ারি ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট (L1)-এ পৌঁছনোর কথা ভারতীয় সৌরযানের। তবে সবকিছু নির্ভর করছে 'হেলো অরবিটে' নিরাপদ অন্তর্নিবেশের উপর। (Halo Orbit)
মহাশূন্যে সূর্য এবং পৃথিবীর মতো দুই বস্তুর পারস্পরিক আকর্ষণ এবং বিকির্ষণের ফলে মাঝে যে স্থিতিশীল অঞ্চল গড়ে ওঠে, তাকে বলে ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট। এই ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্টকে মহাকাশযানের পার্কিং স্পটও বলা হয়। কারণ কম জ্বালানি খরচ করে, সেখান থেকে মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডের উপর নির্বিঘ্নে নজরদারি চালানো যায়। এমন পাঁচটি ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্টের হদিশ পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে মাত্র দু’টি স্থিতিশীল, তার মধ্যে ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট (L1)-এ সৌরযান Aditya-L1 অবস্থান করবে। (Aditya-L1 Mission)
কিন্তু ওই ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট (L1)-এ প্রবেশ করার তখনই সম্ভব হবে, যখন ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট (L1)-কে ঘিরে থাকা ‘হেলো অরবিট’ পার করতে সফল হবে ভারতের সৌরযান। এই ‘হেলো অরবিট’ আসলে ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট L1, L2 এবং L3-কে ঘিরে থাকা পর্যায়ক্রমিক, ত্রিমাত্রিক কক্ষপথ। একটি বিন্দুকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে বলে ঠাহর হয়। দূর থেকে জ্যোতির্বলয়ের মতো দেখায়।
এই কক্ষপথ স্থিতিশীল হয়। পৃথিবী, চাঁদ এবং সূর্যের মহাকর্ষীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে এগোতে পারে মহাকাশযান। মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপগ্রহ এবং মহাকাশযানগুলিকে ‘হেলো অরবিট’-এ প্রবেশ করানো হয়। এখানে মহাকাশযান স্থিতিশীল থাকে। অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হয় না। ধাক্কা লাগে না অন্য মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে। কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট, জেমস ওয়েবের মতো স্পেস টেলিস্কোপের অভিযানে এই ‘হেলো অরবিট’-এর ব্যবহার দেখা গিয়েছে আগেও।
‘হেলো অরবিট’-এ প্রবেশের ক্ষেত্রে আগে থেকে পূর্ব-নির্ধারিত গতিপথ ধরেই এগোয় মহাকাশযান। কোথাও কোনও ভুলচুক যাতে না হয়, দিকনির্দেশে যাতে ভুল না হয়, তার জন্য মহাকাশযানের গতির নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তাই Aditya-L1 সৌরযান ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট (L1)-এর দিকে যত এগোচ্ছে, ততই তৎপরতা বাড়ছে ISRO-র অন্দরে. ২৪ ঘণ্টা সৌরযানের গতি পর্যবেক্ষণ করছেন বিজ্ঞানীরা। কোনও ভাবে যাতে নির্দিষ্ট গতিপথ থেকে ছিটকে না যায়, নজর রাখা হচ্ছে সেদিকে।
একই সঙ্গে সূর্যের তীব্র বিকিরণ এবং নির্গত কণা থেকে সৌরযানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, যেমন, ভিজিবল এমিসন লাইন করোনাগ্রাফ (VELC) এবং সোলার আলট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপ (SUIT)-কে রক্ষা করাও লক্ষ্য বিজ্ঞানীদের। সৌরযান যাতে ‘হেলো অরবিট’ থেকে ছিটকে না যায়, কোনও মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা না লাগে, তার জন্য স্টেশন কিপিং কৌশলও অবলম্বন করা হবে, যাতে অন্য কৃত্রিম উপগ্রহ, মহাকাশযান এবং মহাজাগতিক বস্তুর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় থাকে।
ব্রহ্মাণ্ড, পৃথিবী, গ্রহ, উপগ্রহগুলি কী ভাবে সূর্যের দ্বার প্রভাবিত, এই আলোকমণ্ডলের মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রার নেপথ্যকারণই বা কী, ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট (L1) থেকে পর্যবেক্ষণ করবে Aditya-L1 সৌরযান। সূর্যের উপর নজরদারি চালাতে করোনাগ্রাফ ব্যবহার করবে Aditya-L1 সৌরযান। এই করোনাগ্রাফ হল এমন একটি যন্ত্র, যা সৌরযানের উপর বসানো একটি চাকতি। তাতে সূর্যরশ্মি আবদ্ধ হয়ে যায় এবং ওই চাকতির মধ্যেই সূর্যের বহিরাবরণ ফুটে ওঠে, যা দেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো সম্ভব হয়। এই করোনাগ্রাফ না থাকলে সৌরযানের সেন্সর কাজ করবে না।
করোনাগ্রাফ ছাড়াও, Aditya-L1 সৌরযানে ছ'টি যন্ত্র থাকছে। এর মধ্যে চারটি দূর থেকে সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করার কাজে ব্যবহৃত হবে। বাকি তিনটি সূর্য থেকে সৌরঝড়ের মাধ্যমে বাইরে ঠিকরে বেরনো অণু পরীক্ষা করে দেখবে, সৌরজগতের উপর তার কী প্রভাব, দেখা হবে খতিয়ে। সূর্যের বদমেজাজি আচরণের জন্যই এই সৌরঝড়ের সৃষ্টি, যা মানব সভ্যতার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলে বিদ্যুৎহীন হয়ে যেতে পারে গোটা বিশ্ব। বিঘ্নিত হবে রেডিও সংযোগ, বিমান এবং জাহাজের দিক নির্ধারণে বিপত্তি বাধবে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রবেশ করতে পারে মানবদেহে। তাই সূর্যের বাইরের আবরণের মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রার উৎস বোঝা জরুরি বলে মত বিজ্ঞানীদের, যাতে আগামী দিনে বিপর্যয়ের মোকাবিলা করা যেতে পারে।