নয়াদিল্লি: গ্রামেগঞ্জে, শহরে বাচ্চাচুরির ঘটনা ঘটে। কিন্তু জঙ্গলেও বাচ্চাচুরির ঘটনা সামনে এল এবার। তবে মানুষ নন, বাচ্চাচুরিতে নাম জড়াল বানরদলের। এক প্রজাতির বানর অন্য প্রজাতির শাবক চুরি করছে পানামার একটি দ্বীপে। সিসিটিভি ফুটেজে শাবক চুরির দৃশ্য পর্যন্ত ধরা পড়ল। বানরদের মধ্যে কেন এই প্রবৃত্তি দেখা দিচ্ছে, গবেষণায় তা-ও বেরিয়ে এসেছে। আর সেই কারণ জেনে স্তম্ভিত বিজ্ঞানীরা। (Monkeys Kidnapping in Jungle)
পানামার ছোট্ট দ্বীপ সিকারো থেকে সম্প্রতি এই ঘটনা সামনে এসেছে। ৫৫ কিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটি একটি জাতীয় অরণ্যের মধ্যে পড়ে। সেখানে পশুপাখিদের নিয়ে গবেষণার ব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে জায়গায় জায়গায় বসানো রয়েছে সিসিটিভি, যাতে তাদের গতিবিধির উপর নজরদারি চালানো যায়। আর সেই কাজ করতে গিয়েই বানরদলের বাচ্চাচুরি করার প্রবণতা ধরা পড়েছে। (Viral News)
সিসি ক্যামেরায় একটি কাপুচিন (Capuchin) প্রজাতির বানরের আচরণ দেখে প্রথম সন্দেহ জাগে গবেষক জোয়ি গোল্ডসবরোর মনে। পিঠে লেপটে থাকা বানর শাবককে নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল ‘জোকার’ নামের একটি বয়স্ক বানর। তার নিজের বাচ্চা ভেবেই প্রথমে গুরুত্ব দেননি জোয়ি। কিন্তু গায়ের রং এবং গঠনগত পার্থক্য চোখে পড়তে নড়েচড়ে বসেন তিনি। বুঝতে পারেন, ‘জোকার’ আসলে হাউলার (Howler) প্রজাতির বানর শাবককে তুলে এনেছে।
বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, অন্য সিসিটিভি ফুটেজেও ‘জোকার’কে হাউলার প্রজাতির শাবক পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি অন্য বানরদের পিঠেও অন্য প্রজাতির শাবক চোখে পড়ে। এর পর একে একে ১৫ মাসের ফুটেজ দেখা শুরু হয়। শেষে হিসেব কষে দেখা যায়, ‘জোকার’, তার চার সহযোগী এবং বয়সে তুলনামূলক ছোট একটি বানরও একই কাণ্ড ঘটিয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১১টি হাউলার শাবককে অপহরণ করে তারা।
অন্য প্রজাতির শাবক চুরি করার উদ্দেশ্য কী, শাবকগুলির সঙ্গে তারা কী করছে, প্রথমে বুঝেই উঠতে পারছিলেন না গবেষকরা। ছোট শাবকগুলিকে তারা খেয়ে ফেলছে কি না, তা নিয়েও আশঙ্কা দেখা দেয়। কারণ হাউলার প্রজাতির বানরের অস্তিত্ব এই মুহূর্তে সঙ্কটের মুখে। তারা যাতে বিলুপ্ত না হয়ে যায়, তার জন্য সবরকম চেষ্টা চলছে। কিন্তু পরে দেখা যায়, সেই ধারণা ঠিক নয়। কারণ ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, দিনের পর দিন অন্য প্রজাতিক শাবককে পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বানরগুলি। তবে শাবকের সঙ্গে খেলছেও না তারা, কোনও আগ্রাসন দেখাচ্ছে না, তেমন কোনও আগ্রহও দেখাচ্ছে না শাবকটির প্রতি। এমনিতে পশুপাখিদের মধ্যে একজনের বাচ্চা অন্যজনের চুরি করে নিয়ে যাওয়ার চল আছে। কিন্তু তার নেপথ্যে কোনও উদ্দেশ্য থাকে। এক্ষেত্রে তেমন কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। হনুমানদের মধ্যে অন্যের বাচ্চা দত্তক নেওয়ার চলও আছে। সেক্ষেত্রে বাচ্চাটিকে আদর যত্নে ভরিয়ে রাখা হয়। কিন্তু ‘জোকার’ সেসব কিছুই করছিল না। অপহরণ করে আনা শাবকগুলিকে পিঠে চাপিয়ে শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এতে কেতে না পেয়ে শরীর জীর্ণ হচ্ছিল শাবকগুলির। একটা সময় পর অনাহারে মারা যাচ্ছিল।
এতে আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন গবেষকরা। কিছু করছেই না যখন, তাহলে অন্য প্রজাতির শাবককে কেন অপহরণ করল বাঁদরের দল, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না তাঁরা। এর পর অন্য গবেষকরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নামেন, তাতে বেশ কিছু বিষয় লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে। গবেষকরা জানিয়েছেন, সিকারো দ্বীপে মানুষের বাস নেই। কোনও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, পুরোটাই পাথুরে এলাকা। গবেষণার কাজে এলে সব সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়েই যেতে হয়। সেই মতো নজরদারি চালানো শুরু হয়। আর তাতেই বানরদলের আচরণ দেখে আসল কারণ বুঝতে পারেন গবেষকরা।
গবেষকরা জানিয়েছেন, অন্য জায়গা থেকে এনে জাতীয় অরণ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল কাপুচিন বানরগুলিকে। ফলে এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশে এসে খানিকটা প্রথমে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধা হয় তাদের। অন্যত্র হিংস্র প্রাণী থাকলেও, পানামার ওই অংশে তেমন হিংস্র প্রাণী নেই, তার জেরে তেমন কোনও তাগিদ বা চাঞ্চল্যের কারণ নেই জীবনে। এর ফলে ধীরে ধীরে একঘেয়েমি গ্রাস করে নেয় বানরের দলকে। এমন পরিস্থিতে কাউকে খোঁচাতে পারলে, কিছু ভাঙতে পারলে সাময়িক উত্তেজনা বোধ করে। ঘন জঙ্গলে সেসবে বাধাও নেই তাদের। কেউ সঙ্গে না থাকলেও অসুবিধা হয় না। তাই দিশাহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। এমনকি সিকারোর বানরদের পাথর দিয়ে বাদাম ভেঙে খেতেও দেখা গিয়েছে। সেই অভ্যাসও বানরের সহজাত নয় বলে মত গবেষকদের।
এর আগে, জঙ্গলে ফসল খুঁজে, ধুয়ে তবে খেতে দেখা গিয়েছে বানরকে। জাপানের কোশিমা দ্বীপে স্ত্রী বানরদের মধ্যে ওই অভ্যাস দেখা যায় প্রথম। মানুষকে অনুকরণের অভ্যাসও দেখা গিয়েছে তাদের মধ্যে। একঘেয়েমি গ্রাস করলেই বানররা এসব করে বলে মত গবেষকদের। তাঁদের মতে, এ থেকে মানুষেরও অনেক কিছু শেখার আছে। নিজেদের খামখেয়ালিপনায় অন্যের কতটা ক্ষতি করে ফেলি আমরা, তা বোঝা উচিত বলে মত গবেষকদের।