নয়াদিল্লি: মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে এযাবৎকালীন সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত মিলল। চিতাবাঘের শরীরে যেমন হলুদের উপর কালো ছোপ দেখা যায়, লালগ্রহের পাথরের উপর তেমনই ছোপ দেখতে পাওয়া গিয়েছে, যা প্রাণের অস্তিত্বের চিহ্ন বলে মনে করছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA. গত একবছর ধরে গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন NASA-র বিজ্ঞানীরা। (Science News)
NASA-র বিজ্ঞানীরা Nature জার্নালে যে গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছেন, তাতে এ নিয়ে বিশদ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, গত বছর মঙ্গলের মাটিতে একবারে ভিন্ন ধরনের পাথরের খোঁজ পায় NASA-র Perseverance রোভার। চিতাবাঘের শরীরের মতো, পাথরটির গায়েও কালো কালো ছোপ ছিল। গত এক বছর ধরে সেটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। (NASA on Mars Planet Life Existence)
মঙ্গলগ্রহের ওই বিশেষ পাথরটির নাম রাখা হয়েছে ‘স্যাফায়ার ক্য়ানিয়ন’। লালগ্রহের বুকে ‘নেরেটভা ভ্যালিস’ নদী উপত্যকার পাথুরে মাটি থেকে সেটি সংগ্রহ করে Perseverance রোভার। বিজ্ঞানীদের মতে, আজ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে, মঙ্গলের ওই অঞ্চলে একটি নদী ছিল। সেই নদীর জল গিয়ে পড়ত ‘জেজিরো’ গহ্বরে।
গবেষণার কাজে ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ওই জেজিরো গহ্বরেই নেমেছিল NASA-র Perseverance রোভার। নদীর স্রোতের কোনও প্রভাব পাথরগুলির উপর পড়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছিল। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তীরের মতো দেখতে, Cheyava Falls নামের একটি বড় প্রস্তরখণ্ড ‘স্যাফায়ার ক্যানিয়ন’ নমুনাটি সংগ্রহ করে Perseverance রোভার।
আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিখ্যাত জলপ্রপাতের নামে নামকরণ হয় পাথরটির। তার গায়ের বিন্দু বিন্দু ছোপগুলিকে ‘Poppy Seeds’ও বলা হয়। বড় ছোপ গুলিকে বলা হয় ‘লেপার্ড স্পটস’। Perseverance রোভার-এর একটি টিউবের মধ্যেই রয়েছে ওই নমুনা, পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু ওই পাথরই মঙ্গলের বুকে একসময় প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে বলে মত NASA-র বিজ্ঞানীদের।
NASA জানিয়েছে, পাথরের গায়ে ওই ছোপগুলি দেখে বোঝা যায়, কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়েছিল। Perseverance রোভারে থাকা SHERLOC নামের যে যন্ত্র রয়েছে, সেটি কিছু জৈব যৌগের উপস্থিতি খুঁজে পায় ওই পাথরে। মঙ্গলের অন্য বেশ কিছু জায়গাতেও লাল মাটিকে জৈব উপাদান পাওয়া গিয়েছে। শিরার মতো যে দাগ দেখা গিয়েছে, তা আসলে ক্যালসিয়াম সালফেট, যা জলের উপস্থিতির প্রমাণ হতে পারে। অন্য দিকে, পাথরের উপর কালো ছোপগুলিতে আয়রন এবং ফসফেট পেয়েছে Perseverance রোভারের PIXL যন্ত্রটি। শুধু তাই নয়, পাথরে হেমাটাইটের উপস্থিতিও দেখতে পাওয়া গিয়েছে। হেমাটাইটের জন্যই মঙ্গলের মাটির রং লাল। মঙ্গলের পাথরের উপর ওই ছোপগুলিও সেখানে একসময় অণুজীবের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে।
রাসায়নিক বিক্রিয়ার জেরেই পাথরের গায়ে ওই ছোপ ছোপ দাগ হয়েছে বলে মত বিজ্ঞানীদের। তাঁদের দাবি, হেমাটাইটের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটার ফলেই পাথরগুবি লাল থেকে সাদা হয়ে যায়। সেই সময় নির্গত আয়রন এবং ফসফেট থেকে চাকা চাকা দাগ রয়ে যায়। ওই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলেও অণুজীবের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে পলির মধ্যে বেড়ে ওঠা অণুজীবগুলিও জৈব উপাদান ভক্ষণ করে বেড়ে ওঠে। মঙ্গলেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে থাকবে বলে মত বিজ্ঞানীদের একাংশের।
মঙ্গলের পাথরের উপর ওই ছোপ ছোপ দাগ তৈরি হওয়ার সম্ভাব্য কারণকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন NASA-র বিজ্ঞানীরা, প্রাণের উপস্থিতি, প্রাণের অনুপস্থিতি। ভূজীববিজ্ঞানী তথা জ্য়োতির্বিজ্ঞানী মাইকেল টাইসের মতে, হতে পারে জৈব পদার্থ ও আয়রনের মধ্য়ে বিক্রিয়া ঘটেছে। তবে সেক্ষেত্রে তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশি হয়। কিন্তু তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কোনও ইঙ্গিত পায়নি NASA. আর একটি সম্ভাব্য কারণ তুলে ধরেছেন মাইকেল, তা হল, ৩০০-৩৫০ কোটি বছর বছর আগে মঙ্গলের হ্রদের কাদায় ব্যাকটিরিয়ার বাস ছিল।
গত এক বছর ধরে ওই পাথর নিয়ে গবেষণা চলছিল। বুধবার সাংবাদিক বৈঠক করে শেষ পর্যন্ত নিজেদের আবিষ্কারের কথা জানিয়েছে NASA. Perseverance অভিযানের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী কেটি স্ট্যাক মর্গ্যান বলেন, “একটি সম্ভাব্য জৈব উপাদান আবিষ্কারেরকথা আপনাদের সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। চরিত্রগত ভাবে এটি জৈবিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। সুনিশ্চিতকরণের জন্য এ বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু এই বিষয়টি আপনাদের সকলের সঙ্গে ভাগ না করে নিলেই নয়। NASA-র জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরি, দেশ-বিদেশি সহযোগী সংস্থার ১০০০-এর বেশি বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং সহযোগিতাই এই জায়গায় নিয়ে এসেছে আমাদের।”
NASA-র ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি বলেন, “এক বছর ধরে গবেষণার পর ওঁরা জানান, ‘এর অন্য কোনও ব্যাখ্য়া হতে পারে না।’ মঙ্গলের বুকে প্রাণের অস্তিত্বের স্পষ্ট প্রমাণ এটি, যা আগে কখনও পাওয়া যায়নি।”
২০২৪ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে ওই পাথরটি পাওয়া যায় বলে জানিয়েছে NASA. পাথরের নমুনা পৃথিবীতে আনা গেলে গবেষণাগারে আরও তথ্য উঠে আসবে বলে আশাবাদী তারা। পাথরের নমুনা সংগ্রহের পর Perseverance রোভারটি নদীর উপত্যকায় বিশেষ সমীক্ষা চালায়। বোঝার চেষ্টা করে, পাথরের উপর ছোপ ছোপ দাগ হল কী করে। ভূরাসায়নিক প্রক্রিয়ার জেরে, নাকি অণুজীবের অস্তিত্বের জেরে ওই দাগ সৃষ্টি হয়, তা খতিয়ে দেখা হয়। NASA-র সায়েন্স মিশন ডিরেক্টরেটের সহযোগী প্রশাসক নিকি ফক্স বলেন, “মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, ব্রহ্মাণ্ডে আমরা সত্যিই একা কিনা। সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে আরও একধাপ এগিয়ে গেলাম আমরা।”
NASA-র দাবি, আজ থেকে প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে মঙ্গলের বুকে, ‘নেরেটভা ভ্যালিস’ নদী উপত্যকা দিয়ে নদী বয়ে যেত। কাদামাটি, বালি, নুড়িপাথর গিয়ে জমা হত হ্রদে। একটা সময় পর নদীর জল শুকিয়ে যায়, পড়ে থাকে নুড়িপাথর। ওই নুড়িপাথরই মঙ্গলের বুকে প্রাণের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। যে সময় পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হয়, হতে পারে সেই সময় মঙ্গলগ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব ছিল।
মঙ্গলগ্রহে পৌঁছনোর পর থেকে Perseverance রোভার জেজিরো গহ্বরে অভিযান চালানোর পাশাপাশি, সেখানকার প্রাচীন বদ্বীপেও অণুজীবের খোঁজ চালিয়েছে। একটি একটি করে নমুনা সংগ্রহ করেছে সেটি, যা ভবিষ্যতে পৃথিবীতে তুলে আনার পরিকল্পনা রয়েছে NASA-র। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প মহাকাশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ায়, কবে নমুনাগুলি পৃথিবীতে আনা সম্ভব হবে, সেই নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে মঙ্গলগ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে ওই নমুনাগুলি পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি।