নয়াদিল্লি: শনির বৃহত্তম উপগ্রহের বুকে বিরাট মহাসাগর থাক বা না থাক, কিন্তু প্রাণধারণের উপযুক্ত পরিবেশ থাকতে পারে। এমনকি ভিনগ্রহী জীবের অস্তিত্বও থাকতে পারে বলে এবার উঠে এল গবেষণায়। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA-র নতুন গবেষণা অনুযায়ী, শনির বৃহত্তম উপগ্রহ টাইটানের (Titan) অন্দরমহল সম্ভবত বরফদ্বারা গঠিত। জলকাদার স্তরও থাকতে পারে। টাইটানের পাথুরে অন্তঃস্থলে খোপে খোপে জলও সঞ্চিত থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। (Alien Life on Titan)
২০০৮ সালে NASA-র Cassini অভিযান থেকে টাইটান সম্পর্কে বিশদ তথ্য উঠে আসে। টাইটানের হাইড্রোকার্বন সমৃদ্ধ ভূত্বকের নীচে বিরাট মহাসাগর থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত মেলে সেই সময়। সম্প্রতি সেই তথ্যসমূহ নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন NASA-র জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা। বুধবার Nature জার্নালে সেই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে। (Saturn's Moon Titan
শুধু টাইটানকে বোঝার জন্যই, সৌরজগতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বরফাবৃত উপগ্রহগুলিকে বোঝার জন্য এই গবেষণাপত্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর বাইরে অন্যত্র প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে কি না, তার হদিশ পেতেও আগামী দিনে কাজে লাগতে পারে এই গবেষণা। বিজ্ঞানী বাপতিস্তে জার্নোঁ জানিয়েছেন, পৃথিবীর মতো উন্মুক্ত মহাসাগরের পরিবর্তে, তাঁরা সম্ভবত বরফের মেরুসাগর বা ভূগর্ভস্ত জলাশয় দেখতে পাচ্ছেন। সেখানে কোন ধরনের প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে, পুষ্টি বা শক্তির উপাদানই বা কেমন, তার সেখানকার ভৌগলিক অবস্থার উপরই নির্ভর করবে।
১৯৯৭ সালে Cassini মহাকাশযানটির উৎক্ষেপণ হয়। দীর্ঘ ২০ বছর শনি এবং তার উপগ্রহের উপর নজরদারি চালায় ওই মহাকাশযান। শনিকে প্রদক্ষিণ করার সময় টাইটানের শরীরে সঙ্কোচন ও প্রসারণ চোখে পড়ে সেই সময়। মাটির গভীরে মহাসাগর থাকার দরুণ এমনটা ঘটতে পারে বলে সেই সময় জানান বিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি ছিল, শনির মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবেই টাইটানের শরীরে সঙ্কোচন ও প্রসারণ ঘটে। টাইটানের মাটি নমনীয় বলেও দাবি করা হয় সেই সময়।
কিন্তু টাইটানের শরীরের সঙ্কোচন ও প্রসারণের সময়কাল নিয়ে সম্প্রতি নতুন করে গবেষণা শুরু হয়, যাতে দেখা যায়, টাইটানের উপর শনির মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যখন তীব্রতম হয়, তার ১৫ ঘণ্টা পর টাইটানের আকারে পরিবর্তন
শনি যখন টাইটানের কক্ষপথে তার সবচেয়ে শক্তিশালী মহাকর্ষীয় টান প্রয়োগ করে, তার প্রায় ১৫ ঘণ্টা পরেই টাইটানে পরিবর্তন শুরু হয়। টাইটানের আকারে এহেন পরিবর্তনে কত শক্তির প্রয়োজন, তাও বিশ্লেষণ করে দেখতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। আর তাতেই টাইটানের অন্দরমহলের রহস্য বোঝা সম্ভব হয়।
এমনিতে টাইটানের উপর নজরদারি চালানো সহজ কাজ ছিল না। রাসায়নিক উপাদানের আধিক্য থাকায় শনির বৃহত্তম উপগ্রহের বায়ুমণ্ডল কমলা দেখায়। শক্তিশালী রেডার ছাড়া অন্দরমহলের পরিবেশ বোঝা তাই সম্ভব নয়। তাই Voyager 1, Voyager 2 না পারলেও, সেই কাজে সফল হয় Cassini. তাতে দেখা যায়, মিথেন বৃষ্টির আকারে ঝরে পড়ে টাইটানের মাটিতে, জলভাগের স্থান পরিবর্তন ঘটে, তাপমাত্রা মাইনাস ১৮৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো।
তাহলে টাইটানে জলকাদা, ভূগর্ভে জল এল কোথা থেকে? বিজ্ঞানীদের মতে, টাইটানের বাইরের স্তর জমাট বাঁধা অবস্থায় থাকলে, ভিতরে বরফ, গলিত জলের স্তর রয়েছে এবং সেখানকার পরিবেশ কর্দমাক্ত। টাইটানের কর্দমাক্ত স্তরটি বেশ পুরু এবং টাইটানের আকার পরিবর্তনে যে বিলম্ব ঘটে, তার জন্য কর্দমাক্ত পরিবেশই দায়ী। বিজ্ঞানীদের মতে, এই কর্দমাক্ত স্তরেই জল রয়েছে, যা মহাসাগরের মতো উন্মুক্ত নয়।
Cassini-র সংগ্রহ করে আনা পুরনো তথ্যই শুধুমাত্র বিশ্লেষণ করে দেখেননি বিজ্ঞানীরা। থার্মোডায়নামিক মডেলের সাহায্যে টাইটানের বুকে জল, খনিজ এবং অন্যান্য উপাদানের আচরণও লক্ষ্য় করেন। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, “টাইটানে জলীয় স্তর এতটাই পুরু যে চাপও অত্যধিক। ফলে জলের পদার্থবিদ্যাই বদলে যায় সেখানে। পৃথিবীর তুলনায় টাইটানের বুকে জল এবং বরফের আচরণ একেবারে ভিন্ন।”
তবে টাইটানের বুকে উন্মুক্ত মহাসাগর না থাকলেই আশাহত হওয়ার কারণ নেই বলে মত বিজ্ঞানীদের। তাঁদের মতে, টাইটানের অন্তস্থলে খোপে খোপে যে জল রয়েছে, তাতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। সেখানকার তাপমাত্রা মেরেকেটে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই জলজ প্রাণের অস্তিত্ব থাকা অস্বাভাবিক নয়। টাইটানের উপর নজরদারি চালাতে ২০২৮ সালে Dragonfly অভিযান রয়েছে NASA-র। ২০৩৪ সাল নাগাদ সেটি টাইটানের বুকে অবতরণ করবে। ওই অভিযান থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে মত বিজ্ঞানীদের।