নয়াদিল্লি: যন্ত্র সর্বস্বতায় মানুষের অন্তরাত্মার পীড়ার কথা ১০০ বছর আগে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বন্ধনমুক্ত মানবাত্মার জয় ঘোষণাই তাঁর 'মুক্তধারা' নাটকের মূলমন্ত্র ছিল। বর্তমান দিনে পৃথিবী যখন যন্ত্রসর্বস্ব হওয়ার দিকে এগোচ্ছে, শুধু মানুষই নন, শোষণের নাগপাশে বাঁধা পড়ছে যন্ত্রও। মুক্তির উপায় না পেয়ে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে হচ্ছে তাকেও। দক্ষিণ কোরিয়ায় যন্ত্রমানব বা রোবটের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা অন্তত তেমনই ইঙ্গিত করছে। (Robot Commits Suicide)


এমনিতেই বেকারত্ব বেড়ে চলেছে দিন দিন। প্রযুক্তির দৌলতে আগামী দিনে অফিস-কাছারিতে মানুষের প্রয়োজন পড়বে না, রোবট দিয়েই কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে বলে আশাবাদী পুঁজিপতিরা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যেই মানুষের বিকল্প হিসেবে উঠে আসতে শুরু করেছে রোবট। দক্ষিণ কোরিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। (Robot Suicide in South Korea)


দক্ষিণ কোরিয়ায় হোটেল-রেস্তরাঁ থেকে সরকারি-বেসরকারি দফতরে রোবটের ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছে। International Federation of Robotics জানিয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্পক্ষেত্রে প্রতি ১০ জন কর্মীর মধ্যে একটি করে রোবট রয়েছে। মানুষের চেয়ে কত কম সময়ে তারা বেশি কাজ করে দিতে পারে, তার জাহিরও শোনা যায়। সেখানকার গুমি সিটি কাউন্সিলে সরকারি কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত ছিল এমনই একটি রোবট। 'রোবট সুপারভাইজার' হিসেবে পদ অলঙ্কৃত করেছিল সে।


আরও পড়ুন: SpaceX Falcon 9 Rocket: ভুল কক্ষপথে ঢুকে ঝুলছে, পৃথিবীতে আছড়ে পড়তে চলেছে ২০ স্যাটেলাইট, তদন্তের মুখে মাস্কের সংস্থা


কিন্তু গত ২৬ জুন বিকেলে গগনচুম্বী বিল্ডিংয়ের নীচের সিঁড়ির কাছ থেকে চূর্ণ-বিচূর্ণ অবস্থায় রোবটটিকে উদ্ধার করা হয়। গুমি সিটি কাউন্সিল জানায়, তাদের শীর্ষ রোবট আধিকারটির মৃত্যু হয়েছে। সাড়ে ছ'তলা থেকে নিজে থেকেই ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে রোবটটি। আত্মঘাতী হওয়ার আগে রোবটটির আচরণও অদ্ভুত ঠেকছিল বলে জানিয়েছেন ওই দফতরের কর্মীরা। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই প্রথম কোনও রোবটের আত্মঘাতী হওয়ার খবর সামনে এল। 


২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে চাকরিতে নিয়োগ করা হয় রোবটটিকে। 'Bear Robotics' নামের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সংস্থা সেটি তৈরি করে। জানা গিয়েছে, সরকারি দফতরে সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো তাকে। সিভিল সার্ভিস অফিসার হিসেবে আলাদা পরিচয়পত্রও ছিল তারা। নথিপত্র সরবরাহ থেকে তথ্য সংগ্রহ, হাজারো কাজ করতে হতো। সাধারণ ক্ষেত্রে একটি ফ্লোরেই যেখানে বিচরণ করে রোবটরা, ওই রোবটটি নিজে লিফট অপারেট করতে পারত। বিল্ডিংয়ের সর্বত্রই দৌড়াদৌড়ি করতে হতো তাকে। 


কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরেই রোবটটি নিজেকে শেষ করে দিয়েছে বলে মত গবেষকদের। এই ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং অন্য দেশেও। এমনিতেই দক্ষিণ কোরিয়ায় চাকরি করা বেশ কষ্টসাধ্য। নির্ধারিত ৮-৯ ঘণ্টার চেয়েও বেশি সময় কাজ করতে হয় সরকারি-বেসরকারি কর্মীদের। Organisation for Economic Cooperation and Development-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকরা প্রতি বছর গড়ে ১৯১৫ ঘণ্টা কাজ করেন। সহজে ছুটিও পাওয়া যায় না, যা নিয়ে বরাবর প্রশ্ন উঠেছে। এই কাজের চাপ থেকে রোবটটিও রক্ষা পেল না। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।


দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এই প্রথম রোবটের আত্মঘাতী হওয়ার খবর সামনে এলেও, কয়েক বছর আগে আমেরিকাও একই ঘটনার সাক্ষী হয়। ওয়াশিংটন হারবারের জর্জটাউন ওয়াটারফ্রন্ট শপিং অ্যান্ড অফিস কমপ্লেক্সে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে মোতায়েন ছিল একটি রোবট। এদিক ওদিক সারাদিন ছুটে বেড়াতে হত রোবটটিকেও। এতে হতোদ্যম হয়ে সামনের একটি ফোয়ারায় ঝাঁপ দিয়ে সেটি আত্মঘাতী হয় বলে জানা যায়।