কলকাতা: কলকাতা জাদুঘরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে কত প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। কোনওঘরে পুরনো কোনও সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন। কোনওঘরে প্রাচীন সভ্যতার অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শন। কিন্তু ছোট থেকেই কলকাতা জাদুঘরের যে ঘরটা টানে তা হল মিশরীয় মমির ঘর। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় কীভাবে সংরক্ষিত হতো মৃতদেহ, তা আজও রহস্যের বিষয়। সাধারণ মানুষের কাছে প্রবল কৌতুহলও। কিন্তু এই বিষয়টিই এখন নতুন করে ভাবাচ্ছে সারা বিশ্বের সংগ্রহশালা বা মিউজিয়ামের কর্তৃপক্ষদের। মমি বা প্রাচীন কোনও সভ্যতার কোনও বাসিন্দার দেহাবশেষ কী এভাবেই দ্রষ্টব্য হিসেবে রাখা হবে? নাকি সরিয়ে দেওয়া হবে? চলছে এই আলোচনা।


মিশরীয় মমি নিয়ে রহস্য-কৌতুহল-গল্পকথা সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে। কায়রোর মিউজিয়াম বাদ দিলে, বিশ্বের মধ্যে ব্রিটিশ মিউজিয়ামেই সবচেয়ে বেশি মিশরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর সংগ্রহ রয়েছে। যার একটা বিশাল অংশই হল মিশরীয় মমি (Mummiefied Remains)


অন্য শব্দ:
যদিও লন্ডন মিউজিয়াম ভবিষ্যতে 'Mummy' শব্দটির ব্যবহার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। Daily Mail-এর প্রতিবেদন অনুসারে, মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ মনে করছে এই শব্দবন্ধ মৃত মানুষগুলির প্রতি অসম্মানজনক। একই রাস্তায় হেঁটেছে স্কটল্যান্ডের জাতীয় সংগ্রহশালা, হ্যানককের মিউজিয়াম। তাদের মতে Mummy শব্দটি ভুল নয় কিন্তু অসম্মানজনক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্কটল্যান্ডের জাতীয় সংগ্রহশালার মুখপাত্র জানাচ্ছেন, এখন 'Mummified Person' শব্দটি ব্যবহার করা হবে। যাতে দর্শকরা এদের এক একজন ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে পারে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম, স্কটল্যান্ডের জাতীয় সংগ্রহশালা, হ্য়ানককের গ্রেট নর্থ মিউজিয়াম যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অবশ্য সব প্রত্নতাত্ত্বিক বা মিশরীয় সভ্যতা বিশেষজ্ঞ মেনে নেননি। তাঁদের মতে এটি Popular Culture থেকে নিজেরে আলাদা করার প্রবণতা। কারণ mummy শব্দটি সারা বিশ্বেই পরিচিত এবং ব্যবহৃত হয়। ইংরেজিতে এই শব্দের ব্যবহার বহু প্রাচীন। 


এমন সময়ে এই কাজ করা হল, যখন সারা বিশ্বে মিউজিয়ামে মানুষের মৃতদেহ বা দেহাবশেষ সংরক্ষণ এবং দ্রষ্টব্য হিসেবে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রবল আলোচনা চলছে। অক্সফোর্ডের পিট রিভার মিউজিয়াম (Pitt Rivers Museum in Oxford) কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালেই ঘোষণা করেছিল যে তারা প্রাচীন সভ্যতার কোনও মানুষের দেহাবশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে রাখবে না। ফলে তাদের সংগ্রহে থাকা বহু প্রাচীন প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে থেকে সেগুলি দেখার জন্য সাজিয়ে রাখা হবে না।
কেন এই সিদ্ধান্ত? সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষ যে কারণের কথা বলেছে, তা শুনলে চমকে ওঠার মতো। সেই সময় এই মিউজিয়ামের ডিরেক্টর (museum director) লরা ভ্যান ব্রোখোভেন (Laura Van Broekhoven) একটি বার্তায় বলেছিলেন যে, দর্শকদের নিয়ে হওয়া একটি সমীক্ষায় তাঁরা দেখেছেন, অধিকাংশ দর্শক এই প্রত্নসামগ্রীগুলি দেখে মনে করে ওই সভ্যতা বর্বর, হিংসাশ্রয়ী বা পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী। ফলে অন্য সভ্যতা সম্পর্কে তাঁদের মনে ঋণাত্মক ধারণা জন্ম নেয়। ওই বার্তায় বলা হয়েছিল, মিউজিয়াম এই ধরনের প্রত্নসামগ্রীয় প্রদর্শন করে নানা সভ্যতা সম্পর্কে জানার জন্য এবং গভীরভাবে অনুধাবন করার জন্য। কিন্তু আদতে উল্টোটা হচ্ছে, যা একটি সংগ্রহশালার মূল ভাবনার একেবারে উল্টো।


ফলে এই সময়ে আলোচনা হচ্ছে, মানুষের দেহাবশেষের মতো যা সংগ্রহে রয়েছে সেগুলি মিউজিয়ামগুলি তাদের প্রকৃত উৎস যেখানে সেখানে পাঠিয়ে দেবে কিনা। এমনই একটি উদাহরণ তৈরি হয়েছিল  "Hottentot Venus" নিয়ে। ১৯ শতকে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে--দক্ষিণ আফ্রিকার এক নারীকে প্রদর্শনীর মতো করে দেখানো হতো। যা চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতা এবং অমানবিকতার নিদর্শন। সেই নারীর কঙ্কাল এবং দেহাবশেষ প্যারিসের মিউজিয়ামে প্রদর্শনীতে ছিল ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। পরে তা নিয়ে বহু জায়গা থেকে প্রবল প্রতিবাদ করা হয়। তারপরে সেটিকে প্রদর্শনী থেকে সরিয়ে ফেলে ভল্টে রাখা হয়। তারও অনেক পরে ২০০২ সালে তা দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে তুলে দেওয়া হয়। যদিও মমি নিয়ে এমনটা করা হবে কিনা তার কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ মিশরীয় সভ্যতা এবং মমি সাধারণ দর্শকদের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণের বিষয়। প্যারিসের মিউজিয়ামে তুতানখামেনের একটি প্রদর্শনী রয়েছে। ফারাও তুতানখামেনের সমাধি থেকে পাওয়া একাধিক প্রত্নসামগ্রী দিয়ে তৈরি ওই প্রদর্শনী। তা দেখতে বিপুল সংখ্যক দর্শকদের ভিড় উপচে পড়ে সেখানে। একই ছবি দেখা যায় বিশ্বের নানা সংগ্রহশালায়। 

আরও পড়ুন: বায়ুদূষণ বাড়লে কমছে Bone Density, ক্ষয়ে যাচ্ছে হাড়, দাবি গবেষণায়