নয়াদিল্লি: চাঁদের মাটিতে উপনিবেশ গড়ার ভাবনা চলছে। বিভিন্ন দেশের সরকারি ও বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা এই উদ্যোগে নাম লিখিয়েছে। আর সেই আবহেই চাঁদের সময়কাল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতে এল। জানা গেল, পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের বুকে দ্রুত সময় অতিবাহিত হয়। বিষয়টি সামনে আসতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে। (Moon Standard Time)
চাঁদের মাটিতে কোনও কাজে হাত দেওয়ার আগে, সেখানকার সময়কাল বোঝা জরুরি। পৃথিবীতে যেমন গ্রিনিচ মান মন্দিরকে মাপকাঠি করে সময় ধরা হয়, সেই মতো চাঁদের মাটিতেও সময়ের মাপকাঠি নির্ধারণ করতে বলা হয়েছিল বিজ্ঞানীদের। আর সেই কাজে হাত গিয়েই চমকপ্রদ তথ্য হাতে এল। (Science News)
চাঁদের মাটিতে কখন থেকে সময় গোনা হবে, তা ঘড়ি বসিয়ে নির্ধারণ করা সহজ। কিন্তু সেখানে সময়ের গতি কী, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। এক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানই ভরসা। বহু আগেই সেই নিয়ে নিজের মতামত জানিয়েছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। জানিয়েছিলেন, একঘণ্টা বলতে ঠিক কতখানি সময়, তা নিয়ে একমত না হওয়াই স্বাভাবিক। পৃথিবীর মাটিতে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর সঙ্গে চাঁদের কক্ষপথে উপস্থিত ব্যক্তির হিসেব না মিলতে পারে।
এ ব্যাপারে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি-র থিওরিটিক্যাল পদার্থবিদ বিজুনাথ পাটলা জানিয়েছেন, পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের মাটিতে ঘড়ির কাঁটার গতি ভিন্ন হবে। তাঁর মতে, পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের গতি আপেক্ষিক গতির দরুণ সেখানে পৃথিবীর তুলনায় ঘড়ির কাঁটা আস্তে চলার কথা। কিন্তু চাঁদের অভিকর্ষ শক্তি যেহেতু কম, সেক্ষেত্রে আবার ঘড়ির কাঁটার গতি বেশি হওয়া উচিত। এই দু'টি বিষয়কে ধরলে, পৃথিবী এবং চাঁদের সময়ের মধ্যে ৫৬.০২ মাইক্রোসেকেন্ডের ফারাক হয়। পৃথিবীর থেকে চাঁদের সময় এগিয়ে রয়েছে সামান্য।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বকে সামনে রেখেই চাঁদের সময়কালের হিসেব নির্ধারণ করার কাজে নামেন বিজুনাথ এবং তাঁর সহকর্মী নিল অ্যাশবি। Astronomical Journal-এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন তাঁরা। তাঁরা জানিয়েছেন, ৫৬.০২ মাইক্রোসেকেন্ডের ফারাক রোজকার জীবনযাপনে আহামরি কিছু মনে না হলেও, কিন্তু পৃথিবী এবং চাঁদের মধ্যে সংযোগ তৈরিতে, দিক নির্ণয়ে এবং নির্ভুল অভিযানের ক্ষেত্রে প্রতি মাইক্রোসেকেন্ডই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA-র goddard Space Flight Center-এর সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার শেরিল গ্র্যামলিং জানিয়েছেন, প্রতি ন্যানো সেকেন্ড, অর্থাৎ ০.০০১ মাইক্রো সেকেন্ডে আলো ৩০ সেন্টিমিটার পথ অতিক্রম করে। মানুষের হিসেবে ওই সময়কাল কিছুই নয়। কিন্তু সামান্য এদিক ওদিক হলেই মহাকাশ অভিযান রীতিমতো ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে। ৫৬.০২ মাইক্রোসেকেন্ড এদিক ওদিক হলে দিনে প্রায় ১৭ কিলোমিটার যাত্রাপথ গুলিয়ে যেতে পারে। আর্টেমিস অভিযানের আগে এই সময়কাল জেনে সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে মত তাঁর, যাতে প্রত্যেকটি রোভার, ল্যান্ডার এবং ১০ মিটার অন্তর উপস্থিত মহাকাশচারীদের অবস্থান নির্ভুল ভাবে জানা সম্ভব হয়।
নিউটনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী, সময় চূড়ান্ত বলে কিছু হয় না। অভিকর্ষ শক্তির হেরফেরের দরুণ পৃথিবীতে ঘড়ির কাঁটা ধীরগতিতে এগোতে পারে, অন্যত্র আবার দ্রুতগতিতে এগোতে পারে। তাই GPS স্যাটেলাইট তৈরির সময় আপেক্ষিকতাকে মাথায় রাখতে হয়। পৃথিবী এবং চাঁদের মধ্যে সময়ের ফারাক বোঝাও অত্যন্ত কঠিন কাজ। চাঁদ যেহেতু পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে, আবার পৃথিবীও নিজের অক্ষের উপর ঘোরে এবং সূর্যকেও প্রদক্ষিণ করে, সেক্ষেত্রে ক্ষেত্র আমাদের নজরে চন্দ্রঘড়িকে মনে হতে পারে।
আমাদের ঘূর্ণন এবং আমাদের চারপাশে এর কক্ষপথের কারণে চাঁদ পৃথিবীর পৃষ্ঠের যে কোনও স্থানের সাপেক্ষে চলছে, যার অর্থ আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যে কোনও চন্দ্রঘড়ি ধীর গতিতে চলছে বলে মনে হবে। পাশাপাশি, চাঁদের অভিকর্ষ শক্তি রয়েছে যেমন, পৃথিবীর অভিকর্ষ শক্তির প্রভাবও ঘড়ির উপর পড়ে। কৃত্রিম উপগ্রহের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না কারণ, সেগুলির আকারও তেমন বড় নয়, তাদের নিজস্ব অভিকর্ষ শক্তিও নেই। সবদিক মাথায় রেখে, জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও ৫৬.০২ মাইক্রোসেকেন্ডের ফারাক বের করা গিয়েছে। মহাকাশ অভিযানে হিসেব করে সেই মতো ঘড়ি চালালে, সুবিধা হবে মহাকাশচারীদের।