কলকাতা: এক বছর আগের ক্ষত এখন দগদগে তাঁদের মনে। গত বছর মে মাসের এক অভিশপ্ত দিনে নিমেষে তছনছ হয়ে গিয়েছিল ঘরদোর, চাষের ক্ষেত, সাজানো সংসার। আমফানের করাল গ্রাসে রীতিমতো মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর।


কার্যত ধ্বংসস্তুপ থেকে ফের বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজেশ্বরী দাস। বাংলার সেরা হাইজাম্পার ও তাঁর পরিবার মিলে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। সংসারের একমাত্র আয় পানের বোরজ ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। নতুন করে ফের চাষবাষ শুরু করেছিলেন। অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফের একটি ঘূর্ণিঝড়ের ভ্রুকুটি। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস-এরও ল্যান্ডফল হতে পারে সাগর-পারাদ্বীপ অঞ্চলে। ফের উৎকণ্ঠার প্রহর গুনছে সাগরের বাসিন্দা রাজেশ্বরী ও তাঁদের প্রতিবেশীরা।


এবিপি লাইভ-কে মোবাইল ফোনে বাংলার কৃতি হাইজাম্পার বললেন, 'রবিবার রাতে ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছিল। তবে আজ (সোমবার) সকাল থেকে চারিদিক থমথমে। প্রবল অস্বস্তিকর গরম। ভীষণ গুমোট ভাব। ঝড়ের আগের পরিচিত নিস্তব্ধতা। বাড়ির ও পাড়ার কেউই এখনও আমফানের তাণ্ডব ভুলতে পারিনি। ফের একটা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আসছে। বেশ আতঙ্কেই সময় গুনছি।'


সাগরের সুমতিনগরে বাড়ি রাজেশ্বরীর। জানা গেল, সাগরে চারদিকে মাইকে করে প্রচার চলছে। ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন কী করা উচিত আর কী নয়, সেসব নিয়ে প্রশাসনের তরফে জনগণকে সতর্ক করার কাজ চলছে। পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী সব প্রস্তুত।


রাজেশ্বরী বলছেন, 'এখানে অনেকেরই কাঁচা বাড়ি। আমাদের বাড়ির কাছেই সুমতিনগর হাইস্কুল। প্রত্যেক বছর বন্যা হয় বলে ফ্লাড সেন্টারও রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগে স্কুলবাড়ি ও ফ্লাড সেন্টারে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ধজপাড়া সুমতিনগর ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে সেখানে শুকনো খাবার, পানীয় জলের জোগান তৈরি রাখা হচ্ছে।' আমফানে রাজেশ্বরীদের টালির চালের বাড়ি ভেঙে পড়েছিল। বাবার পান বোরজ তছনছ হয়ে গিয়েছিল। নতুন করে বাড়ি তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছে দাস পরিবার। রাজেশ্বরী বলছেন, 'তবে সে বাড়ি এখনও অর্ধসমাপ্ত। পাশেই আমার কাকার পাকা বাড়ি। সেখানেই আপাতত বাবা, মা ও দাদার সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছি।'


আমফানের আতঙ্ক এমনই মনে গেঁথে রয়েছে যে, সারাদিন বাড়িতে নিউজ চ্যানেল চালিয়ে রেখেছেন। ইয়াসের গতিপ্রকৃতির হদিশ রাখতে। রাজেশ্বরী বলছেন, 'বেশ ভয় হচ্ছে। হওয়ারই কথা। আমফান ঝড়ে যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল! আমাদের এখানে সকলের প্রধান কৃষিকাজ পানের বোরজ। গতবার সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমার বাবার একমাত্র উপার্জনও ওই বোরজ থেকেই। সেটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে সেটা কিছুটা দাঁড় করাতে পেরেছে। ফের ঘূর্ণিঝড় আসছে। আবার ক্ষতি হলে কী হবে ভাবছি।'


আমফানের স্মৃতি ভুলতে পারেননি সাগরের কেউই। রাজেশ্বরী বলছেন, 'সেদিন সকাল ১০টা থেকে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছিল। সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। দুপুরের দিকে চতুর্দিক তছনছ হয়ে গেল। হাওয়ার ধাক্কায় ঘর ভেঙে গিয়েছিল। কাকার বাড়ি দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম।' 


বাড়ির অদূরে নদী। বাঁধ ভেঙে প্রত্যেক বর্ষায় এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। রাজেশ্বরী বলছেন, 'আমার মামারবাড়ি নদীর পাড়েই। নদীবাঁধ মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে শুনলাম।' স্থানীয় বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা গোটা এলাকা ঘুরে ইয়াস মোকাবিলার কাজের তদারকি করছেন। আর টিভির পর্দায় চরম উদ্বেগের সঙ্গে চোখ রেখেছেন রাজেশ্বরী ও তাঁদের মতোই সাগরের হাজার হাজার মানুষ। ইয়াসের স্থলভাগে আছড়ে পড়ার প্রহর গোনা চলছে।